সাত মাস আগে সারাদেশে আলোড়ন তোলা সেই হত্যাকাণ্ডের মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নুসরাতের মায়ের করা মামলার পর থেকেই ক্ষিপ্ত হন আসামিরা।
অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর আসামিদের কয়েকজন কারাগারে তার সঙ্গে দুই দফা দেখা করতে গিয়ে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা পেয়েই মাঠে নামেন। আর এই পরিকল্পনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজের অনুগতরা, যাদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ছাত্র, অধ্যক্ষের আত্মীয় এমনকি নুসরাতের সহপাঠীও ছিলেন।
পিবিআইয়ের ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে অধ্যক্ষ সিরাজকে এক নম্বর আসামি করা হয়। অভিযুক্ত ১৬ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে নুসরাতের মায়ের করা মামলার ভিত্তিতে অধ্যক্ষ সিরাজকে ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
আর এরপরই সিরাজের তার পক্ষ নেয় স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তি দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী। মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ ছিল।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১ এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীম (নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন), নূরু উদ্দিন (অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ), ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের (নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু) ও ইফতেখার উদ্দিন রানা জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। তখনই অধ্যক্ষ তার মুক্তির চেষ্টা এবং মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে বলেন।
৩ এপ্রিল শামীম, নূর উদ্দিন, আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজন কারাগারে গিয়ে আবার অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। সিরাজ তখন নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন আর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর নির্দেশ দেন।
সেদিন বিকালে মাদ্রাসার পাশে একটি টিনশেড কক্ষে শামীম, নূর উদ্দিন, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (নুসরাতের সহপাঠী), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি ও নুসরাতের সহপাঠী) ও কামরুন নাহার মনি (আসামি শামীমের দূরসম্পর্কের ভাগ্নি, নুসরাতের সহপাঠী) ও আরও কয়েকজন বৈঠক করে। নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় ওই বৈঠকেই ।
৪ এপ্রিল রাতে মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে বসে আবারও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন আসামিরা। পরদিন ভূইয়া বাজার থেকে এক লিটার কেরোসিন কিনে নিজের কাছে রেখে দেন শামীম।
৬ এপ্রিল সকাল ৭টার পর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে যান শামীম, নূর উদ্দিন ও হাফেজ আব্দুল কাদের। সকাল সোয়া ৯টার মধ্যে আসামিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যার অবস্থানে চলে যান।
শামীম পলিথিনে করে আনা কেরোসিন অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাসে নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেন। আর মনির কেনা দুটি এবং বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটি বোরখা এবং চার জোড়া হাতমোজা নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলায় রাখা হয়।
শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরখা ও হাতমোজা পরে তৃতীয় তলায় অবস্থান নেন।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপি তাকে মিথ্যা কথা বলে ছাদে নিয়ে আসেন। নুসরাতকে বলা হয়, তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে কারা যেন মারছে। নুসরাত ছাদে যাওয়ার সময় পপি তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। নুসরাত তাতে রাজি না হয়ে ছাদে উঠে যান। মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদও সে সময় নুসরাতের পিছু পিছু ছাদে যান।
পপি তখন নুসরাতের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দেন। জোবায়ের ওড়না দুই ভাগ করে ফেলেন। পপি ও মনি ওড়নার একাংশ দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে বেঁধে ফেলেন। অন্য অংশ দিয়ে নুসরাতের পা বেঁধে ফেলেন জোবায়ের। জাবেদ পায়ে গিট দেন।
সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ওপর শুইয়ে ফেলেন। শাহাদাত তখন নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখেন। নুসরাতের বুকের ওপর চেপে ধরেন মনি। পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে।
জাবেদ বাথরুমের পাশে গ্লাসের রাখা কেরোসিন এনে ঢেলে দেন নুসরাতের গায়ে। শামীমের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ জ্বেলে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
আগুন ধরানোর পর প্রথমে ছাদ থেকে নামেন জোবায়ের। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী মনি ‘চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে পপিকে নিচে নিয়ে যান। তারা নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান।
জাবেদ ও শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরখা খুলে ফেলেন। তারপর জাবেদও পরীক্ষার হলে ঢুকে যান।
শামীম তার বোরখা ফেলে দেন মাদ্রাসার পুকুরে। জোবায়ের মাদ্রাসার মূল গেইট দিয়ে বের হয়ে যান এবং বোরখা ও হাতমোজা ফেলে দেন সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে।
এদিকে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত নিচে নেমে এলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড তার গায়ের আগুন নেভায়। নূর উদ্দিনও ওই সময় নুসরাতের গায়ে পানি দেন। আর হাফেজ আব্দুল কাদের ফোন করে নুসরাতের ভাই নোমানকে জানান, তার বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
দেহের ৮০ শতাংশজুড়ে আগুনের ক্ষত নিয়ে নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে ঘটনা একইভাবে বর্ণনা করেন বলে অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে।