“দেহেন আমরার এই গরমই সৌভাগ্য। অহন বৃষ্টি অইলে আমরার বিরাট ক্ষতি অইয়া যাইবো।”
Published : 27 Apr 2024, 12:20 AM
নানা কারণে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে ওঠেছে। টানা রোদে পুড়ছে সারাদেশ। তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করা মানুষ একটু স্বস্তি পেতে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করছেন। গরমের প্রকোপ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষায় স্কুল-কলেজ বন্ধ দিয়েছে সরকার।
এ অবস্থায় নেত্রকোণার হাওরপাড়ের চিত্র পুরো ভিন্ন। সেখানকার কৃষকরা বলছেন, তাপপ্রবাহ চললেও এই মুহূর্তে তারা বৃষ্টি চান না। আরও রোদ্রোজ্জ্বল দিন তাদের কাম্য। কারণ সেখানে চলছে ‘দাওয়ামারি’- পুরোদমে বোরো ধান কাটা।
তারা বলছেন, এখন বৃষ্টি তাদের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ, এখন বৃষ্টি হলে শিলা থাকবে; তাতে ক্ষেতে থাকা পাকা ধান সব মাটিতে ঝরে পড়বে। সেটা আর রক্ষা করা যাবে না।
অপরদিকে কাটা ধান যদি রোদ না পায় তাহলে তাতে ‘জ্বালা’ বা চারা গজিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। এই ধানের কোনো বাজারমূল্য থাকবে না। সারাবছর মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে এখন কৃষককে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
এ বছর এরই মধ্যে তাপপ্রবাহ রেকর্ড গড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, আগে দেশে সর্বোচ্চ ২৩ দিন টানা দাবদাহের রেকর্ড ছিল। এ বছর তা এরই মধ্যে ২৭ দিন অতিক্রম করে গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে প্রায় ৭৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পৌঁছেছে।
শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ ওঠেছে। টানা এই তাপ প্রবাহের কারণে সারাদেশে ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে এবং সেটি বাড়ানো হয়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এই সময়ে সারাদেশে গরমে ১০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
এই ভয়ানক অবস্থায় চিকিৎসক ও আবহাওয়াবিদরা মানুষকে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের না হতেই পরামর্শ দিচ্ছেন। ছায়াযুক্ত স্থানে বসে কাজ করার কথা বলছেন। এবং এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচলও কমে গেছে।
কিন্তু হাওরের দৃশ্য ভিন্ন। সারা বছরের খোরাকি জোগাতে এই তীব্র রোদ মাথায় নিয়েই তাদের ক্ষেতের ধান কাটতে নামতে হচ্ছে। গা-পোড়া গরমের মধ্যেই তাদেরকে কড়া আগুনে মণ-কে-মণ ধান সিদ্ধ করতে হচ্ছে চুলার পাশে বসে। কষ্ট হলেও যেন এ সময় তাদের ক্লান্তি আসা মানা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ ছাড়াও কলমাকান্দা, বারহাট্টা ও আটপাড়ার একাংশ নিয়ে নেত্রকোণার হাওরাঞ্চল। এ বছর এই হাওরাঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কৃষক ৪১ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে আবাদ করেছেন।
হাওরজুড়ে আগাম উফশি-৮৮, ৮৯, ৯২ ও হাইব্রিড জাতের ধান পাকায় কৃষকরা আনন্দের সঙ্গে ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ করছেন।এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তারা মনের আনন্দে ধান শুকিয়ে গোলায় তুলছেন।এ বছর ২ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন ধান হাওরে উৎপাদন ধরা হয়েছে।
হাওরপাড়ের মানুষরা বলছেন, তাদের জীবনে বৈশাখের দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেখানকার এক ফসলি জমির বোরো ধানই তাদের সারা বছরের সংসার চালানোর অর্থনৈতিক জোগানের উৎস। এ ফসল গোলায় তোলার পর সেখানের মানুষেরা আনন্দ উৎসবে মাতেন।
পহেলা বৈশাখের আগে-পরে ধান কাটা শুরু হলেও কোথাও কোথাও এখন পর্যন্ত ৭০-৭৫ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। ধান শুকিয়ে গোলায় তোলা হচ্ছে। হাওরজুড়ে ছেলে-বুড়ো, নারী-শিশু সবাই বোরো ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বৈশাখের তাপপ্রবাহ চলার মধ্যেই মাঠে মাঠে কেউ ধান কাটছেন, কেউ ধান মাড়াই-ঝাড়াইয়ের কাজ করছেন, কেউবা ধান সিদ্ধ করছেন, আবার কেউ ধান শুকানোর কাজ করছেন।
তপ্ত রোদে পুড়ে কাজ করছিলেন খালিয়াজুরী উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের কৃষক জয়নাল মিয়া। হাওরের বোরো ধানের ফলন ও কর্তন নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে গরমের এই সময়টাতে কিছুটা স্বস্তি পেতে বৃষ্টি হলে কেমন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরার হাওরে অহন বৃষ্টি অইলে মরণ ছাড়া গতি নাই। এমন অকথা-কুকথা কইয়েন না।
“আমরার লাইগ্যা রোইদ অইতাছে সোনার গোলা। আমরার অহন খালি রইদ আর রইদ দরকার।”
তিনি বলছিলেন, “কয়টা দিন গরমের মধ্যে ভালায় ভালায় ধান ঘরে তুইল্যা ফালাইতে পারলেই সারা বছর কিচুডা নিশ্চিন্ত অয়ন যায়। এইডা আমার একলার না। হাওরজুইড়া বেবাকের (সবার)।”
সারাদেশ যখন তাপে পুড়ছে তখন রোদই যেন স্বস্তির জায়গা একই উপজেলার আমানিপুরের কৃষক জমির উদ্দিনের। তিনি বলেন, “আর কয়ডা দিনইতো। বেশিরভাগ ধান কাইট্যা ফালাইছি। দিনডা যদি অহনের মতো দিয়া যায়, তাইলে বেবাক ধান কাটা শেষ আইবো।
“আমরা বৃষ্টি চাই না। অহন বৃষ্টি অইলো আমরার দুঃস্বপ্ন। রইদ অইলো আমরার লক্ষ্মী।”
খালিয়াজুরীর কৃষ্ণপুর গ্রামের সবিতা বর্মণ বলেন, “আমরার এলাকার সবাই অহন ধান তোলায় দিন-রাইত কাম করতাছে। ভালা রইদ দিয়া যাইতাছে। আর কয়ডা দিন এইবায় গেলেই আমরার লাইগ্যা ভালা।”
গরম আর বৃষ্টির প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বলেন, “দেহেন আমরার এই গরমই সৌভাগ্য। অহন বৃষ্টি অইলে আমরার বিরাট ক্ষতি অইয়া যাইবো। আমরা বৃষ্টি চাই না। আমরার প্রার্থনা, আর অন্তত একটা সপ্তাহ এইবায় রোইদই থাহুক। আমরার ফসল ঘরে তুইল্যা ফালাই।”
মদন উপজেলার পাছআলমশ্রী গ্রামের কৃষাণী সখিনা বেগম রোদের মধ্যে ধান সিদ্ধ ও শুকানোর কাজ করছিলেন।
তিনি বলেন, “দেহেন অতো রইদ, অতো গরম। এর পরেও আমরার আনন্দই। এইবার যে ধান অইছে তা ঘরে নেয়নই আমরার চিন্তা। রইদ থাকতে থাকতে সব ধান জমি থেইক্যা নিয়াম।”
হাওরে ৬১৩টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন ধান কাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে কৃষকের খরচ যেমন কম হচ্ছে, তেমনি শ্রমিক নিয়েও তারা সঙ্কটে নেই বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান।
তিনি বলেন, “অনুকূল আবহাওয়া, বীজ, সার, সেচ সবই প্রয়োজনমতো সঠিক সময়ে পাওয়ায় হাওরজুড়ে এবার বোরো ধানের ‘উফশি’ ও ‘হাইব্রিড’ জাতের অভাবনীয় ফলন হয়েছে। হাইব্রিড আর উফশি মিলিয়ে গড়ে একরে ৮০ মণ ধান ফলন হচ্ছে।
“ফলন ভাল হওয়ায় আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আরও ৩০ হাজার মেট্রিকটন ধান বেশি উৎপাদন হবে। ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকেরা খুশিতে আছেন।”
হাওরপাড়ে অনুকূল আবহাওয়া বলতে কেমন আবহাওয়াকে বোঝায় এই প্রশ্নের উত্তরে এ কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “ধান কর্তনে রৌদ ঝলমলে আবহাওয়া দরকার। কৃষকরা ধান কর্তনের পর ওই ধান সিদ্ধ করবেন, রোদে শুকাবেন। পরে গোলায় তুলবেন। সেখানে বৃষ্টি হলে মাঠের ধান ঘরে তোলার ক্ষেত্রে শঙ্কার সৃষ্টি হবে।
“এ রকম সময়ে সবচেয়ে ভয়ের বিষয় বৃষ্টির হলে শিলা থাকে। আর শিলাবৃষ্টি হলে কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই আমরাও দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দিচ্ছি। হাওরের মাঠে মাঠে দ্রুত ধান কাটতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার পাঠিয়েছি।”
আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে হাওরের পুরো ধান কাটা শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। কৃষকরাও জোরকদমে ধান কাটছেন। বাকি দিনগুলো রোদেলা গেলেই ভাল। কৃষকের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে বলে জানান মোহাম্মদ নূরুজ্জামান।
জেলার কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা ধান ৮০ শতাংশ পাকলেই কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষকদের।
সম্ভাব্য দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দ্রুত ধান কাটা শেষ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ধানের শীষের উপরের দিক থেকে ৫ ভাগের ৪ ভাগ পাকলেই তা ৮০ শতাংশ পাকা হয়েছে বুঝতে হবে এবং সেই ধান কর্তণের শতভাগ উপযোগী।”