নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে স্থানীয় রাজনীতিও: ডিআইজি

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় রাজনীতিও প্রভাব রেখেছে বলে দাবি করেছেন এই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান ডিআইজি এস এম রুহুল আমিন।

ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 April 2019, 04:59 PM
Updated : 18 April 2019, 05:18 PM

নুসরাতের গায়ে আগুন ধরানোর আগে গ্রেপ্তার ‘যৌন নিপীড়ক’ মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষে-বিপক্ষে কর্মসূচি পালিত হয়েছিল স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগের মদদে, যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ডিআইজি রুহুল বৃহস্পতিবার বিকালে ফেনীতে সাংবাদিকদের বলেন, “নুসরাতের ঘটনার সাথে স্থানীয় রাজনীতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে। একই দলের দুইজন কাউন্সিলর অধ্যক্ষের পক্ষে-বিপক্ষে মানববন্ধন করেছে।”

ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজকে ছাত্রী নুসরাতকে যৌন নিপীড়নের মামলায় গত ২৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হলে পরদিন তার পক্ষে-বিপক্ষে কর্মসূচি পালিত হয়েছিল সোনাগাজীতে।

সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি দাবির কর্মসূচিতে মদদ জোগান বলে অভিযোগ উঠেছে। নুসরাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি, বহিষ্কৃত হয়েছেন দল থেকেও।

অন্যদিকে অধ্যক্ষ সিরাজের শাস্তি দাবিতে কর্মসূচিতে সমর্থন ছিল আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আবদুল হালিম মামুনের।

নুসরাত হত্যামামলায় গ্রেপ্তার কাউন্সিলর মাকসুদ আলম

স্থানীয়রা জানায়, জামায়াতে ইসলামীর এক সময়ের নেতা ও নাশকতার কয়েকটি মামলার আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ আওয়ামী লীগ নেতাদের হাত ধরেই মাদ্রাসায় তার ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিলেন।

মাকসুদের আগে মামুনের সঙ্গেও অধ্যক্ষ সিরাজের ঘনিষ্ঠতার কথা স্থানীয়রা বলেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মাদ্রাসা কমিটিতে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে পরে মাকসুদ ও অধ্যক্ষ সিরাজ এক হন।

ডিআইজি রুহুল আমিন বলেন, “অধ্যক্ষের অনেক খারাপ হিস্ট্রি রয়েছে, যা গভর্নিং বডির সদস্যরাও জানত। যদি তার ব্যাপারে আগে ব্যবস্থ্যা নেওয়া হত, তাহলে আজকে এধরনের ঘটনা ঘটত না।”

গত বছরের ৩ অক্টোবর আরেক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে, যা চাপা পড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠার পর ফেনী সদরের দৌলতপুর সালামতিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাকে।

জামায়াতের রোকন হিসেবে নাশকতার তিনটি মামলায় ২০১৪ সালে কিছু দিন কারাগারেও ছিলেন সিরাজ। আর্থিক অনিয়মসহ নানা অভিযোগে ২০১৬ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে জানান ফেনী জেলা জামায়াতের আমির এ কে এম শামসুদ্দিন।

এই অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা যৌন নিপীড়নের মামলা প্রত্যাহার না করায় জীবন দিতে হল নুসরাতকে

এরপর অধ্যক্ষ সিরাজ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক তার অনিয়ম চালিয়ে যেতে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন বলে স্থানীয়রা জানায়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে মাদ্রাসা কমিটিতেও ঢোকানো হয় এই প্রক্রিয়ায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে থাকার কারণে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যেত না।

তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মামুন অধ্যক্ষ সিরাজকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করছেন। 

ওসি মোয়াজ্জেমও ‘ছাড় পাবে না’

যৌন নিপীড়নের মামলার পর নুসরাতের জবানবন্দি নিয়েছিলেন সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ওই জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এই কাজ এবং নুসরাতের সঙ্গে তার আচরণ নিয়ে ওঠে সমালোচনার ঝড়।

সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, যার বিরুদ্ধে নুসরাতের জবানবন্দি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে

তার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে ওই ওসির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তার আগে তাকে সোনাগাজী থানা থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়।

ডিআইজি রুহুল আমিন বলেন, “ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। আমরা অনেকের সাথে কথা বলেছি। নুসরাতের ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের কোনো গাফিলতি বা দায়িত্বে অবহেলা থাকলে, অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।”

নুসরাতের মা শিরীনা আক্তার মেয়েকে নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করার পর সেই মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছিল নুসরাতকে, যাতে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না।

গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে ছাদে ডেকে নিয়ে কেরোসিন ঢেলে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, দেহের ৮০ শতাংশে ক্ষত নিয়ে পাঁচ দিন পর ঢাকার হাসপাতালে মারা যান এই তরুণী।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডে তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।  

হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কি না বা এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কী করা উচিৎ, তা তদন্ত ও অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর, যার নেতৃত্বে আছেন ডিআইজি রুহুল আমিন।

সাংবাদিকদের মুখোমুখি ডিআইজি এস এম রুহুল আমিন

বুধ ও বৃহস্পতিবার ফেনীতে তদন্ত চালানোর পর তিনি বলেন, “তদন্ত কার্যক্রম শেষ হতে আরও তিন-চার দিন লাগতে পারে। নথিপত্র যাচাই-বাচাই চলছে।

“সাধারণ একটি মামলা তদন্ত করতে এক মাস সময় লাগে। এটি একটি বড় ঘটনা, তাই কিছুটা সময় লাগবে। পুরোপুরি তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।”