ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ারের নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সরকার।
Published : 22 May 2019, 03:05 PM
তদন্ত কমিটি বলেছে, এফ আর টাওয়ারের ১৮ তলার নকশা অনুমোদন করা হয়েছিল বিধি লঙ্ঘন করে। তার ওপরে আরও পাঁচটি ফ্লোর নির্মাণের নকশাকে বৈধতা দিতে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি হয়। ত্রুটি ও নিয়মের বত্যয় ছিল ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রেও।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন হাউজিং লিমিটেড ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
পাশাপাশি ওই জমির মালিক সৈয়দ মো. হোসাইন ইমাম ফারুক এবং এফ আর টাওয়ার ওনার্স সোসাইটিও অগ্নি দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না বলে কমিটি মনে করছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেন, যাদের নাম এ প্রতিবেদনে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২৮ মার্চ এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৭ নিহত হওয়ার পর এই ভবন নির্মাণে নানা অনিয়মের বিষয়গুলো বেরিয়ে আসতে থাকে।
এই ভবনের জমির মূল মালিক ছিলেন প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভবনটি নির্মাণ করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড। সে কারণে সংক্ষেপে ভবনের নাম হয় এফআর টাওয়ার।
অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তার একটি গঠন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী বলেন, ১৯৯০ সালে এফ আর টাওয়ারের মাল্টি পারপাস কমার্শিয়াল ১৫ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং অনুমোদন যথাযথ ছিল।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে ওই ভবনের ১৮ তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ইমারত বিধিমালা মানা হয়নি।
“১৯৯৬ সালের ইমারত বিধিমালা জারি হওয়ার পরেও বনানীর এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদন করা হয় ১৯৮৪ সালের পুরনো বিধিমালার আলোকে।এক্ষেত্রে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম তার দায় এড়াতে পারেন না। “
এই বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে হুমায়ুন খাদেম ছাড়াও রাজউকের সাবেক সদস্য ডি এম ব্যাপারী, রাজউকের সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ জাকির হোসেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান, সাবেক অথরাইজড অফিসার-২ সৈয়দ মকবুল আহমেদ, সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহ এবং জমির মূল মালিক এস এম এইচ আই ফারুককে দায়ী করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর এফআর টাওয়ারের ১৮ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। ভবন মালিক ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজউকে আরও একটি নকশা পেশ করেন, যেটি ছিল ২৩ তলার।
“রূপায়ন হাউজিং কর্তৃক দাখিলকৃত ওই ২৩ তলার নকশাটি বৈধ ছিল না। কথিত ২৩ তলার নকশার ওপর ভিত্তি করে ২০, ২১ ও ২২ তলার বিপরীতে ঋণ গ্রহণের জন্য বন্ধকের অনুমতি দেওয়াও সঠিক ছিল না। রাজউক উক্ত ভবন নির্মাণে ব্যত্যয় সম্পর্কে অবগত থাকলেও এ বিষয়ে তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।”
একটি ‘সংঘবদ্ধ চক্র’ জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে ২৩ তলার ওই নকশা সে সময় তৈরি করে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “২৩ তলার নকশাটি বৈধতা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রেজিস্ট্রারে অবৈধ এন্ট্রি ও ইস্যু দেখিয়ে এবং ওই নকশার সাহায্যে বিভিন্ন ফ্লোর হস্তান্তর, বন্ধকের অনুমতি প্রদান এবং ঋণ গ্রহণের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজউকের মোট ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে তদন্তে।”
এফ আর টাওয়ার নির্মাণে যে ত্রুটি ও ব্যত্যয় ঘটেছে, সেখানে রাজউকের নয়জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর অবহেলা ও দায় নিরূপণ করেছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এফ আর টাওয়ারের জরুরি বহিঃর্গমন ও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নকশা অনুযায়ী হয়নি। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও যথাযথভাবে ইমারত বিধি অনুসরণ করা হয়নি।
“ভবন নির্মাণে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে রূপায়ন হাউজিং লিমিটেড অবহেলার পরিচয় দিয়েছে। সাথে সাথে বরাদ্দগ্রহীতা, এফ আর টাওয়ার প্রোপার্টিজ লিমিটেড এবং এফ আর টাওয়ার ওনার্স সোসাইটি উক্ত ভবনে ব্যবসা পরিচালনাসহ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকায় দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।”
তদন্ত কমিটি বলছে, এফআর টাওয়ারে ফায়ার অ্যালার্ম ছিল না। ফায়ার এক্সিট সিঁড়িতে ছিল প্রতিবন্ধকতা। ফায়ার এক্সিটের দরজার সামনে রুম করে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। ফলে আগুন লাগার পর লোকজন দ্রুত বের হতে পারেনি। জানমালের ক্ষতি তাতে বেড়েছে।
“এক্ষেত্রে সৈয়দ মো. হোসাইন ইমাম ফারুক (জমির মূল মালিক) এবং ভবনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত এফ আর টাওয়ার প্রোপার্টিজ লিমিটেড এবং এফ আর টাওয়ার ওনার্স সোসাইটি দায়ী।”
>> এফ আর টাওয়ারের ভূমির মালিক পরে ১৮ তলার বাড়তি অবৈধ অংশ অপসারণের জন্য রাজউকের কাছে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ১৮ তলার ওপরের অবৈধভাবে নির্মিত অংশের সুবিধা তিনিও ভোগ করেছেন।
>> এফ আর টাওয়ারের ১৮ তলার উপরে অবৈধ অংশের নির্মাণের জন্য দায়ী রূপায়ন হাউজিংয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অবৈধভাবে তৈরি ওই নকশায় আমমোক্তার গ্রহীতা হিসেবে রূপায়নের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরও স্বাক্ষর ছিল।
>> ওই জাল নকশায় স্বাক্ষরকারী অথরাইজড অফিসার সৈয়দ নাজমুল হুদা, সহকারী অথরাইজড অফিসার বশির উদ্দিন খান এবং ইস্যু রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ভবনের অবৈধ অংশ নির্মাণকালে রাজউকের যেসব তদারককারী কর্মকর্তা ছিলেন, তারাও দায়ী।
>> অবৈধভাবে নির্মিত অংশের ২০,২১ ও ২২ তলা বন্ধক রাখার ক্ষেত্রে রাজউকের অনুমতি প্রদানকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও দুর্নীতিতে জড়িত।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ
# রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেমসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
# টাওয়ারের অবৈধ অংশ অপসারণের নির্দেশ দিতে হবে। কারিগরি কারণে বা জনস্বার্থে তা ভাঙা বা অপসারণ সম্ভব না হলে স্থায়ীভাবে সিলগালা করে দিতে হবে।
# এফআর টাওয়ার নির্মাণকালে রাজউকে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্বে ছিলেন এবং অবৈধ অংশের বন্ধকের অনুমতি দেওয়ার সময় যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী জানান, এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউকের আটটি জোনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মোট ১৮১৮টি ভবন পরিদর্শন করেন।
এসব ভবনের মধ্যে ১১৩৬টি ভবনে রাজউক অনুমোদিত নকশা পাওয়া যায়। আর ২০৭টি ভবনের নকশা ছিল অন্যান্য সংস্থার অনুমোদিত।
৪৩১ জন ভবন মালিক রাজউকের অনুমোদিত নকশা দেখানে ব্যর্থ হন। এর মধ্যে ৪৪টি সরকারি ভবনেরও নকশা দেখাতে পারেননি কর্মকর্তারা।
ভবন পরিদর্শনের বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “যারা নকশা অনুমোদনে ব্যর্থ হয়েছে বা হবেন তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”