এফআর টাওয়ার: রাজউকের অনিয়মও আসছে বেরিয়ে

ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ার ১৮ তলার উপরের যে অংশকে ‘অবৈধ’ বলছে রাজউক; এই সংস্থাই সেই অংশের তিন তলা বন্ধক রেখে ঋণ নিতে রূপায়নকে অনুমতি দিয়েছিল।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2019, 05:18 PM
Updated : 22 May 2019, 11:16 AM

বহুতল এই বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকাণ্ড তদন্তে গঠিত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কমিটির তদন্তে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে; কমিটি ওই সময়ে এই অনুমোদনে জড়িত রাজউকের সংশ্লিষ্ট সবার নামও চেয়েছে।

রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড দাবি করেছে, রাজউকের অনুমতি নিয়েই ভবন পাঁচতলা বাড়ানো হয়েছিল, ঋণের আবেদন মঞ্জুরই তার প্রমাণ।

তবে রাজউক কর্মকর্তারা এখন বলছেন, রূপায়ন কোনো অনুমতিই নেয়নি, জাল নকশা ব্যবহার করে ভবন উঁচু করেছিল।

নিয়মবহির্ভূতভাবে এই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় রাজউকের এস্টেট ও ভূমি শাখার তৎকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করছেন সংস্থার এখনকার কর্মকর্তারা।

এই অনিয়মে রাজউকের কারও যোগসাজশ থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

গত ২৮ মার্চ এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৭ নিহত হওয়ার পর এই ভবন নির্মাণে নানা অনিয়মের বিষয়গুলো বেরিয়ে আসতে থাকে।

এই ভবনের জমির মূল মালিক ছিলেন প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভবনটি নির্মাণ করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড। সে কারণে সংক্ষেপে ভবনের নাম হয় এফআর টাওয়ার।

অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তার একটি গঠন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

এই কমিটির সদস্য সচিব মো.  ফাহিমুল ইসলাম গত ১৬ এপ্রিল রাজউকের উপ-পরিচালকের (এস্টেট ও ভূমি-১) কাছে একটি চিঠি পাঠান।

তাতে বলা হয়, “এফ আর টাওয়ার সংক্রান্ত নথির নোটাংশের নোটানুচ্ছেদ ৮৬ ও ৮৭ প্রেক্ষিতে উক্ত ভবনের এবিসিডি ২০, ২১ ও ২২ তলার অফিস স্পেসগুলো জিএসপি ফাইন্যান্স বাংলাদেশ লিমিটেডের অনুকূলে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।”

ওই নথির সংশ্লিষ্ট নোটাংশে স্বাক্ষরকারী রাজউকের প্রত্যেক কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর নাম ও ঠিকানা তদন্ত কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়।

১৮ তলার অনুমতি নিয়ে ২৩ তলা করা হয় এফআর টাওয়ার

গত ১৮ এপ্রিল রাজউক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির কাছে ছয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম, ঠিকানা পাঠায়।

এতে দেখা গেছে, এস্টেট ও ভূমি শাখার সদস্য মো. রেজাউল করিম তরফদার, পরিচালক মো. শামসুল আলম, মুহাম্মদ শওকত আলী, সহকারী পরিচালক শাহ মুহাম্মদ সদরুল আলম, তত্ত্বাবধায়ক সহকারী পরিচালক জাহানারা বেগম এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মজিবুর রহমান মোল্লা ওই নথিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

২০০৪ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে ২০০৬ সালের ৪ জুলাই পর্যন্ত রাজউকে প্রেষণে কর্মরত ছিলেন তৎকালীন উপসচিব মো. রেজাউল করিম তরফদার।

উপসচিব মো. শামসুল আলম ২০০৫ সালের ৯ অক্টোবরে প্রেষণে রাজউকে আসেন। ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী ২০০৪ সালের ১৯ অক্টোবর প্রেষণে উপ-পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। তাকেও ২০০৭ সালের ৩১ অক্টোবর অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এই তিন কর্মকর্তার বর্তমান অবস্থান ও ঠিকানা নেই রাজউকের কাছে।

সহকারী পরিচালক সদরুল আলম রাজউকে কর্মরত, থাকেন রাজউকের বনানী কোয়ার্টারে।

তত্ত্বাবধায়ক সহকারী পরিচালক জাহানারা বেগম অবসরে গেছেন।

অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মজিবুর রহমান মোল্লা সাময়িক বরখাস্ত।

এই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছেন জানিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি আগামী সপ্তাহে তা প্রকাশ করবেন।

নিয়ম অনুযায়ী, রাজউক এলাকায় সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে হলে রাজউকের অনুমতি নিতে হয়।

ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জিএসপি ফাইন্যান্স নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালের ১৮ জানুয়ারি রূপায়নকে ৩ কোটি ৬০ টাকা ঋণ অনুমোদন করে।

চুক্তি অনুযায়ী, ঋণের ওই টাকা কাসেম ড্রাইসেলস কিস্তিতে পরিশোধ করে, যারা ওই ভবনের ওই তলাগুলো কিনেছিল। 

ওই ঋণ মঞ্জুরির জন্য রূপায়ন হাউজিং এস্টেটের নামে অনুমিতপত্র ইস্যু করে রাজউক। ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রাজউকের এস্টেট ও ভূমি শাখার সহকারী পরিচালকের কার্যালয় থেকে অনুমতি দেওয়া হয়।

২০০৫ সালের ১৩ মার্চ ৫ কোটি ৬৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকায় এফআর টাওয়ারের ২১, ২২ এ ২৩ তলা কিনতে রূপায়নের চুক্তি করে কাসেম ড্রাইসেলস। এরমধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা বন্ধকী ঋণ হিসেবে জিএসপি ফাইন্যান্সের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়।

২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড তিনটি ফ্লোরের হস্তান্তরপত্র দেয়। ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি তিনটি ফ্লোরের ১৭ হাজার ৬৭০ বর্গফুট অফিস স্পেস এবং ৫টি কার পার্কিং হস্তান্তর করে রূপায়ন।

রূপায়নের দেওয়া নকশা ‘জাল’

অগ্নিকাণ্ডের পর গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী রেজাউল করিম বলেছিলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৮ তলা ভবন অনুমোদনের জন্য এফআর টাওয়ারের নকশায় অনুমোদন দেওয়া হয়। ভবন মালিক ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজউকে আরও একটি নকশা পেশ করেন।

“আমরা খবর নিয়ে দেখি, রাজউকে যে নকশা সংরক্ষিত আছে, তার সঙ্গে সেটির মিল নেই। পরে সেই ঘটনায় ২০০৭ সালের দিকে তদন্ত করে রাজউক। তদন্তে দেখা গেছে, ভবনটি মূল নকশার ব্যত্যয় ও বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।”

রাজউক থেকে জানা গেছে, এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত শুরুর পর রূপায়ন রাজউকে উপরের পাঁচটি ফ্লোরের নকশা জমা দেয়। তবে এই নকশা রাজউকে রক্ষিত মূল নকশার সঙ্গে মেলে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজউক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আরও কয়েকটি কাগজপত্র দিতে পারেনি রূপায়ন।

“নকশায় তারা যে স্মারক নম্বর দিয়েছে, তা আরেকটা নথির স্মারক নম্বর। ওই নম্বরে কোনো নথিই পাওয়া যায়নি। নকশা সংশোধন করলে পরিবেশ, ফায়ার, সিভিল এভিয়েশনসহ কয়েকটি সরকারি সংস্থার ছাড়পত্র নিতে হয়। তারা কোনো ছাড়পত্র নেয় নাই। রাজউকে নকশা অনুমোদনের ফি দিতে হয়, সেই ব্যাংকে সেই ফি জমা দেওয়ার রশিদও আবেদনের সঙ্গে দিতে হয়। তারা এটাও দিতে পারে নাই।

“এই নকশা শতভাগ জাল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই,” বলেন এই কর্মকর্তা।

এতে রাজউকের তৎকালীন কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন বলে স্বীকার করেন তিনি।

“ফেইক এসব কাগজপত্র বানিয়ে তারা পাঁচ তলা করিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এতদিন কেউ ধরতে পারেনি। এফআর টাওয়ারে আগুন না লাগলে কেউ এ বিষয়ে খোঁজও নিত না। এতে রাজউকের লোকজনও আছে যাদের নাম তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।”

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমানের মোবাইলে কল দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।

রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিয়াকত আলী খান মুকুল বর্তমানে রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি বিদেশে বলে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তবে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের উপদেষ্টা পাটোয়ারি জহির উল্লাহ (পি জে উল্লাহ) দাবি করেছেন, তারা অনুমতি নিয়ে বৈধভাবেই ২৩ তলা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও বলছি, আমাদের ওই অংশটুকু বৈধ। একটা জিনিস তো ক্লিয়ার আমরা রাজউকে নকশা দিয়েছি, রাজউক অনুমোদন দিয়েছে। লোনের জন্য অ্যাপ্লাইয়ে রাজউক ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে। সেই লোনটা আবার আমাদের কাছ থেকে যিনি কিনেছেন তিনি ইউজ করেছেন।”

“দোষ-ত্রুটি কিছু থাকলে তা রাজউকের লোকজনের মধ্যে। আমরা তো জানি না কে কে সই করল, কে করল না,” বলেন পি জে উল্লাহ।

বর্ধিত অংশের আবেদনের জন্য ব্যাংকের রশিদ এবং ছাড়পত্রের ব্যাপারে জানতে চাইলে পি জে উল্লাহ বলেন,

“তখন এগুলো প্যাকেজ আকারে দেওয়া হত। অথরাইজড অফিসার থাকে, ইন্সপেক্টর থাকে, তাদের একজনকে প্যাকেজ হিসেবে দিয়ে দিয়েছে।

“আমাদের যিনি করেছেন ইফতেখার সাহেব, তিনি এখন নাই আমাদের সঙ্গে… আমরা এটা এখন দেখাতে পারছি না। এটা অনেকদিন আগের, ১৫ বছর আগের কথা।”

গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্তে রাজউকের কয়েকজনের নামও এসেছে, তারা সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। সবাই দায়ী হয়ে যাচ্ছে।

“এই ঘটনার সঙ্গে মালিক, ডেভেলপার শুধু নয়, যারাই এর সঙ্গে জড়িত আছে তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তদন্ত প্রতিবেদনে কী রয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন বিস্তারিত কিছু বলছি না। সংবাদ সম্মেলন করে সবকিছু সামনে নিয়ে আসব।”