বাংলা চলচ্চিত্রে প্রায় চার দশক দাপুটে বিচরণের পর সংসদ সদস্য হিসাবে নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রতিনিধিত্ব করা সারাহ বেগম কবরী আবারও চাইছেন জনগণের সেবা করার সুযোগ।
Published : 14 Aug 2018, 07:34 PM
চলচ্চিত্রে নিজের দীর্ঘ দিনের কাজের ধারাবাহিকতায় এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ের’; তরুণ প্রজন্মের শিল্পী ও কলা-কুশলীদের জন্য জাতীয় সংসদের ভেতর থেকে কাজ করতে চান তিনি।
সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী রাজনীতি নিয়ে তার ভাবনাগুলো মেলে ধরেছেন, বলেছেন আগামী দিনের পরিকল্পনার কথা।
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রায় পৌনে ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরলেন, তখনই মূলধারায় রাজনীতিতে আসার ইচ্ছাটা কবরীর ভেতরে দানা বাঁধতে শুরু করে।
তবে ভোটের মাঠে নামার সুযোগটা তার সামনে আসে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। আওয়ামী লীগ সভনেত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নৌকার টিকেট তুলে দেন কবরীর হাতে। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তেমন একটি ‘পুরস্কার’ তিনি চান।
“স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে মেইনস্ট্রিমের নেতাদের সঙ্গে কাজ করেছি। ওখান থেকে একটা ধারণা হল- যদি নমিনেশন পাই। শেষ পর্যন্ত শামীম ওসমান যখন পালালো, তখন আপা বললো- ‘আপনারতো ইলেকশন করার খুব ইচ্ছা... আমার পক্ষ থেকে এটা আপনার জন্য পুরস্কার’।
কবরী বলেন, “ওই কথাটা বলে আমাকে আপা নমিনেশনের কাগজটা দিলেন। সেজন্য আই অ্যাম ভেরি গ্রেটফুল টু হার।”
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে দেশে ফিরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শামীম। কিন্তু ২০০৭ এর শুরুতে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে জরুরি অবস্থা জারি করলে আবারও দেশ ছাড়েন তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফেরেন শামীম ওসমান। কিন্তু ততদিনে ওই আসন থেকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ওসমান পরিবারের এক সময়ের বধূ কবরী।
এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে শামীম ওসমানকেই মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির বর্জনের মধ্যে ওই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি। কবরীও আর পুরনো নির্বাচনী এলাকায় খুব একটা যান না।
এবার কোন আসন থেকে মনোনয়ন চাইছেন- এ প্রশ্নে কবরী বললেন, তার ভাবনায় আছে ঢাকার গুলশান এলাকা। তবে বিষয়টি তিনি ‘নেত্রীর’ ইচ্ছার ওপরই ছেড়ে দিতে চান।
ঢাকার গুলশানে যে এলাকায় কবরী থাকেন, তা পড়েছে ঢাকা-১৭ আসনের অধীনে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) প্রার্থী এস এম আবুল কালাম আজাদ গত নির্বাচনে ওই আসনের এমপি নির্বাচিত হন।
গতবছর বইমেলায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয় কবরীর আত্মজৈবনিক রচনা ‘স্মৃতিটুকু থাক’। সেখানে অভিনয় জীবনে কবরীর নানা ব্যক্তিগত স্মৃতির পাশাপাশি ভোটের মাঠে ওসমান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার তিক্ততার প্রসঙ্গও আসে।
নিজের প্রথম ভোটের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে এক সময়ের দাপুটে এই চিত্রনায়িকা লিখেছেন, “যারা আওয়ামী লীগ করে না, যারা রাজনীতিই করে না, তারাও এক নজর কবরীকে দেখতে ছুটে আসছে। পান খাওয়া এক মহিলা আমার গালে এমন চুমা দিলেন যে গাল লাল হয়ে গেল। এত কষ্টের মাঝেও অনেক আনন্দ হয়।”
কবরীর ভাষায়, “আমি রাজনীতিকে প্রাত্যহিক জীবন থেকে আলাদা করে দেখি না। রাজনীতি তো কাজ। শুধু কাজ নয় বিরাট দায়িত্বও। সিনেমাতে কাজ করতে গিয়ে ভাবতাম অনেক কাজই তো করেছি, এবার রাজনীতিতে আসলে কেমন হয়? তাহলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করা যাবে।”
রাজনীতির বিষয়ে কবরীর আগ্রহটা তৈরি হতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন থেকেই নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে নিতে শুরু করেন।
“ভাবতাম, রাজনীতি করলে কী দাঁড়াবে; বুঝতেই পারি নাই। স্বাধীনতার আগে দেশ সম্পর্কে সচেতনতা বোধ সবসময় কাজ করত। কিন্তু রাজনীতি বিশ্লেষক বা রাজনীতিবিদদের সাথে মিছিল-মিটিং করা আমার ছিল না। আমার চোখ খুলে গেল একাত্তরের যুদ্ধের পরে।”
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর আরও অনেকের মত পালিয়ে ভারতে চলে যান কবরী। সেখানে রাজনীতির জগতের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হতে শুরু করে। রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা ‘একটু একটু করে স্পষ্ট’ হতে থাকে। কিছুদিন কলকাতায় কাজ করার পর একটি চলচ্চিত্রের কাজে মুম্বাই গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের কাজেও যুক্ত হন।
“এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খান সারওয়ার মুরশিদ, ন্যাপের আলতাফ হোসেনসহ অনেকে ওখান থেকে টিম করে হায়দ্রাবাদ গিয়েছিলাম। আমরা শিল্পী হিসাবে, উনারা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক হিসাবে কী দেখেছেন- আমরা ওখানে গিয়ে মিটিং করলাম। একাত্তরে আমার মনে হল, আমি নতুনভাবে পৃথিবীকে দেখতে থাকলাম।”
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের এই প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারে জনমত গঠনে যুক্ত ছিলেন। বিচারপতি সোবহান, ড. নীলিমা ইব্রাহীমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা প্রতিষ্ঠার কাজেও ছিলেন তিনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে ‘ওসমান পরিবারসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকের’ দিক থেকে বাধা এসেছিল মন্তব্য করে কবরী বলেন, “আমি থেমে যাইনি। কারণ আমার শক্তিতো প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা। আপা নমিনেশন দিয়েছিলেন আমাকে।”
আবার মনোনয়ন পেলে জয়ী হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কবরীকে যেখানে দাঁড় করাবে, সেখানে আমি যথেষ্ট- যদি রেটিং করা হয়… সংসদ সদস্য ছিলাম, কিন্তু আমার মত এই সৎ ও সাহসী মানুষ পাওয়া যাবে কি-না সেটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমি কোনো দুর্নীতি করি নাই, টেন্ডারবাজি করি নাই, জমি দখল করি নাই।
“মানুষ ভাবে এমপি মানে টাকা রোজগার করা, অনেক কিছু করার রাস্তা। আমি কিন্তু সেটা বুঝি নাই। সে কারণে আজকে একটা সিনেমা করার জন্য আমার টাকা নাই।”
আবার সংসদে যাওয়ার সুযোগ পেলে চলচ্চিত্র শিল্পকে ঢেলে সাজানোর স্বপ্নের কথা জানান চার দশকে দুই শতাধ্কি সিনেমায় আলো ছড়ানো এই অভিনেত্রী।
“আমি চাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে নতুনভাবে সামনে এগিয়ে নিতে। নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে চলচ্চিত্র যেন তার সোনালী যুগে ফিরতে পারে। তাদের হাত ধরে যেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বড় আকারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হতে পারে।”
কবরী বলেন, “আমি চলচ্চিত্রের মানুষ। আমি যাই করি না কেন চলচ্চিত্র আমার কাছে ইবাদতের মত। চলচ্চিত্র ঘিরে আমি অনেক কাজ করতে চাই। জানপ্রাণ দিয়ে সেখানে পরিবর্তন আনতে চাই।”