খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে নির্বিকার নির্বাচন কমিশন এ ভোটের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে ‘ত্রুটি ও ঘাটতি’ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার কথা বলেছে।
Published : 18 May 2018, 12:19 PM
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবারের ওই ভোটে ২৮৬ কেন্দ্রের মধ্যে অনিয়মে স্থগিত তিন কেন্দ্র বাদ দিয়ে গড়ে ৬২ শতাংশ ভোট পড়েছে।
পরাজিত প্রার্থী এবং বিএনপির তরফ থেকে ভোটের দিন শতাধিক কেন্দ্রে জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে; পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোও অন্তত ১২ ধরনের অনিয়ম দেখার কথা বলেছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। তবে নির্বাচন কমিশনের ভাষায়, খুলনায় ভোট হয়েছে ‘চমৎকার, সুন্দর, উৎসবমুখর’ পরিবেশে।
রিটার্নিং অফিসারের ঘোষিত ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, মেয়র পদে ২৮৬টি কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কেন্দ্রে ৯১.৩৮ শতাংশ, ৯৭.৬০ শতাংশ ও ৯৯.৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে।
এর মধ্যে একটি কেন্দ্রে সিল মারা বাকি ছিল কেবল একটি ব্যালট পেপারে। এছাড়া ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে নয়টি কেন্দ্রে; ৪৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৭০ শতাংশের বেশি।
স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে কোনো কোনো কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোটের হারকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন না নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম।
তার যুক্তি, মেয়র পদে এবার দলীয় প্রতীকে ভোট হওয়ায় ভোটারদের আগ্রহ বেশি ছিল। তাছাড়া কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরাও ব্যাপক প্রচার চালিয়ে ভোটারদের উৎসাহ যুগিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, একটি কেন্দ্রে মেয়র পদে শুধু একটি ব্যালট বাকি ছিল। কিন্তু সেখানে ২৪৭টি ভোট বাতিল হয়েছে। ওইগুলো বাদ দিলে কোনোভাবেই ৯০% এর ওপরে কাস্ট ধরা যায় না।”
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভোট কেন্দ্রে নারী ভোটার।
খুলনার ভোটের বিষয়ে তার ভাষ্য, “দুই তিনটা কেন্দ্রে বাতিল ভোট বেড়ে যাওয়ায় হয়ত ৯০ শতাংশের ওপরে গেছে। বাড়াবাড়ি-অনিয়ম পাওয়ায় তিনটি কেন্দ্র তো স্থগিত করা হল। কিন্তু কোথাও তো ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে, ভোট দিতে পারেননি- এমনতো হয়নি।”
সুতরাং খুলনায় অনিয়ম হয়েছে- এটা ঢালাওভাবে বলা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “একটি কেন্দ্রে মাত্র ২৩ শতাংশ, আরেক কেন্দ্রে ৩৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। অনিয়ম হলে সেখানে তো আরও ভোট পড়ে পারত।”
কমিশন বৃহস্পতিবার খুলনার ভোটের ফল পর্যালোচনা করেছে জানিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, “কোনো কেন্দ্রে কেন কম ভোট পড়ল, আবার কোথাও কেন বেশি ভোট পড়ল- তা পর্যালোচনা করেছি। কোথাও কিছু ত্রুটি-ঘাটতি যে হয়নি, তা বলা যাবে না। পুরো পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের মধ্যেও কিছু অসন্তুষ্টি রয়েছে। যেসব বিষয়ে ঘাটতি ছিল তা আগামীতে দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমরা একমত হয়েছি।”
তবে মঙ্গলবারের ভোট নিয়ে নতুন কোনো ব্যবস্থা বা অনিয়মকে কেন্দ্র করে এ মুহূর্তে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
“যে কেন্দ্রটিতে ভোট কম পড়েছে ওই এলাকা শ্রমিক অধ্যুষিত, অনেকে অনুপস্থিত ছিল। আবার যেখানে বেশি ভোট পড়েছে সেখানে হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীরা বেশি সক্রিয় ছিল। ৯৯.৯৪ % যেখানে পড়েছে সেখানে কিছু একটা থাকতে পারে। কিন্তু কখনো কখনো এমন ভোট পড়াটাও একেবারে অস্বাভাবিক না।”
কেন্দ্রে ভোটের হার সবচেয়ে কম ২২.৬৫% ভোট পড়েছে ১১৭ নম্বর কেন্দ্রে ২০-৩০%: ১১৭ নম্বর কেন্দ্রে ২২.৬৫% ভোট পড়েছে ৩১-৪০%: ৬৩ নম্বর কেন্দ্রে ৩৪.১৮% ভোট পড়েছে ১৬টি কেন্দ্রে ভোটের হার ৪১ থেকে ৫০% ৮১টি কেন্দ্রে ভোটের হার ৫১ থেকে ৬০% ১৩০টি কেন্দ্রে ভোটের হার ৬০-৭০% ৪৫টি কেন্দ্রে ভোটের হার ৭১-৮০% ৯টি কেন্দ্রে ভেটের হার ৮১-৯০% এর মধ্যে৭২ নম্বরে ৮৭.৫৭%, ১৮৫ নম্বরে ৮১.৬৩%, ২১১ নম্বরে ৮৫.৭৯%, ২১৭ নম্বরে ৮০.১৬%, ২৩০ নম্বরে ৮০.১৪%, ২৩৭ নম্বরে ৮১.৩৪%, ২৩৮ নম্বরে ৮৩%, ২৫৩ নম্বরে ৮০.৩৯% এবং ২৭৪ নম্বরে ৮৮.৬২% ৭৩, ৭৪ ও ১৮৪ নম্বর কেন্দ্রে ভোটের হার ৯১ থেকে ১০০% এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৯.৯৪% ভোট পড়েছে ৭৩ নম্বর কেন্দ্রে ২০২, ২৭৭ ও ২৭৮ নম্বর কেন্দ্রের ভোট স্থগিত |
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর একটি মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডাব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম বুধবার জানান, তাদের পক্ষ থেকে ১৪৫টি কেন্দ্র ভোটের দিন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংসতা এবং নির্বাচনী অনিয়ম সেখানে তাদের চোখে পড়েছে।
কেন্দ্রের ভেতরে সহিংসতা, অবৈধ সিল মারা, ভোটদানে বাধা, ভোটারদের যানবাহনের সুবিধা দেওয়া, কেন্দ্রে অনুমোদিত উপস্থিতি, ভোটারকে কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া, পর্যবেক্ষককে বাধা, কেন্দ্রের ৪০০ গজের ভেতরে প্রচারণা, বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অবস্থান- এরকম অনিয়মের তথ্য পাওয়ার কথাও আব্দুল আলীম জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “যদিও বেশ কিছু কেন্দ্রে নির্বাচনী ফলাফল পরিবর্তনের জন্য সহিংসতা ও নির্বাচনী অনিয়ম করার প্রচেষ্টা হয়েছে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন ওই সব ঘটনার ব্যাপকতা বেশি না হওয়ায় তা ভোটের ফলাফল পরিবর্তনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।”
৭৩ নম্বর কেন্দ্রের ফলাফল
৭৪ নম্বর কেন্দ্রের ফলাফল
১১৭ নম্বর কেন্দ্রের ফলাফল
অবশ্য বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অভিযোগ, খুলনা ভোটে নির্বাচন কমিশন ছিল ‘একচোখা’। তারা এক চোখ বন্ধ করে কাজ করছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অনুকূলে।
“নির্বাচন কমিশন নিজেদের স্বাধীনতা অস্বীকার করে সরকারের পরাধীন হওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ করেছে। এই কমিশন সরকারেরই ফটোকপি, তাদের কম্প্রোমাইজড কপি।”
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও ইসির কাজে সহায়তা করতে হবে। সবকেন্দ্রে অনুমোদিত এজেন্ট দিতে হবে। বিধি মেনে ঠিকভাবে এজেন্ট না দিয়ে শুধু অভিযোগ আনলে ইসির জন্যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
“নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে না দিয়ে দলগুলোকেও আইন-বিধি মেনে ভোটে কাজ করতে হবে,” বলেন তিনি।
রফিকুল ইসলাম জানান, যে তিনটি কেন্দ্র স্থগিত হয়েছে, সেখানে অনিয়মের কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
ইসির যুগ্ম সচিব খোন্দকার মিজানুর রহমানকে প্রধান করে উপ সচিব ফরহাদ হোসেন ও সিনিয়র সহকারী সচিব শাহ আলমকে সদস্য করা হয়েছে এ কমিটির।
ফরহাদ হোসেন জানান, আগামী ২৭ মের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।