পার্বত্য শান্তিচুক্তির অধিকাংশ শর্ত বাস্তবায়িত হওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে সব শর্ত এখনও বাকি আছে সেগুলোও বাস্তবায়িত হবে।
Published : 01 Dec 2017, 08:56 PM
শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ‘নিপীড়ন-নির্যাতনে’ জুম্মদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে বলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা উদ্বেগ জানানোর দুদিনের মাথায় এ আশ্বাস দিলেন প্রধানমন্ত্রী।
এই চুক্তির দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার বিকালে গণভবন থেকে তিন পার্বত্য জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে শেখ হাসিনা বলেন, “চুক্তির ৭২টি শর্তের মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৫টি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাকি নয়টিও বাস্তবায়ন হবে।”
চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় ২০১৬ সালে আইন সংশোধন করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য তিন জেলার বেশ কিছু দ্বায়িত্ব জেলা পরিষদের হাতে হস্তান্তরের কথা ছিল। ইতোমধ্যে আমরা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ৩০টির মত বিষয়, বান্দরবানে ২৮টি বিষয় এবং রাঙামাটিতে ৩০টি বিষয় হস্তান্তর করেছি। সেনা ক্যাম্পগুলি চাহিদা মতো প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।”
এছাড়া সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, মোবাইল ফোন পরিবেসা চালু, প্রাথমিক, কারিগরি, মেডিকেল কলেজসহ উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল গড়ে তোলাসহ ওই এলাকার অর্থ-সামাজিক, পর্যটন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি।
দুর্গম থানচি এবং নৈগর্সিক সৌন্দর্যের সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “এভাবে চুক্তির সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে।”
তবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি ‘জটিল’ বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
এই সমস্যার সমাধানে ভূমি কমিশন করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি আশা করি, আঞ্চলিক পরিষদ যদি সহযোগিতা করে আমরা এটা বাস্তবায়ন করতে পারব।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কোনও এলাকার মানুষ অবহেলিত থাকবে, সেটা আমরা চাই না। সেদিকে লক্ষ্য রেখে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের সাথে সাথে চুক্তির বাইরেও সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কাজ ব্যাপকভাবে আমরা করে দিচ্ছি। এ অঞ্চলটা দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। সে কারণে আমরা বিশেষ প্রকল্প নিয়ে উন্নতি করে দিচ্ছি।”
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বিদ্রোহী জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের চুক্তির মাধ্যমে ওই অঞ্চলে প্রায় দুই যুগের সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটে। এর তিনমাস পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন বিদ্রোহীরা।
চুক্তির দুই দশক পূর্তি সামনে রেখে বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) অভিযোগ করেন, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর দুই-তৃতীয়াংশই এখনও অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “চুক্তিতে সেনাবাহিনীর সকল প্রকার অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান থাকলেও এখনও চার শতাধিক ক্যাম্প পার্বত্যাঞ্চলে রয়েছে। সেনাশাসন চলমান হেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধে যত্রতত্র সেনা অভিযান, তল্লাশি, ধরপাকড়, মারপিট, দমন-পীড়ন এবং বাক স্বাধীনতা ও সভা সমাবেশের উপর হস্তক্ষেপ চলছে।”
চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে অসন্তোষ থেকে পাহাড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটলে তার দায় সরকারকে নিতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি।
ওই সংবাদ সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির নেতাদের সঙ্গে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, মানবাধিকারকর্মী নুমান আহমেদ খান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক এন্ড্রু সলোমার উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির সমালোচনা
শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করায় বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “যেদিন অস্ত্র সমর্পণ হয়, সেই দিন বিএনপি হরতাল ডাকে। আমি অবাক হয়ে যাই, কেউ শান্তিচুক্তির পর যদি অস্ত্র সমর্পণ করতে আসে সেখানে হরতাল ডেকে অস্ত্র সমর্পণে বাধা দেওয়া এটা কী কারণে?
“আমার মনে হয়, এই অস্ত্র বেচা-কেনার সঙ্গে তাদের কেউ কেউ জড়িত ছিল, দুপয়সা কামায় করত। হয়ত ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে যাবে বলেই বোধ হয় এ বাধাটা দিত। তাছাড়া কিছুই না।”
ওই সময়ের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এমনও কথা বলেছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। উনি তখন ফেনী থেকে সংসদ সদস্য। আমি যখন আমার বক্তব্যে জিজ্ঞেস করলাম, ফেনী পর্যন্ত ভারত হলে উনাকে তো ভারতে গিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে বসতে হবে। উনি ভারতের পার্লামেন্টে বসে আছেন কি না?”
এভাবে ‘অবান্তর কথা’ বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সংঘাত অবসানের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা করা হয়।
“পৃথিবীতে বহু দেশে এ ধরনের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো দ্রুত কেউ করতে পারেনি।”
চুক্তি বাস্তবায়নে বিলম্বের জন্য বিএনপিকে দায়ী করে তিনি বলেন, শর্ত অনুযায়ী কাজ শুরু হলেও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারায় চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ ‘স্থবির’ হয়ে যায়।
“বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। এটা সবারই জানা উচিত তারা কিন্তু এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।”
এরপর ২০০৯ সালে আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হওয়ার পর চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ গতি পায় বলে জানান তিনি।
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্স সঞ্চালনা করেন মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন জনপ্রতিনিধি, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।