যাত্রীদের চাহিদা মতো গন্তব্যে না যাওয়া এবং বাড়তি ভাড়া নেওয়ায় সমালোচিত অটোরিকশা চালকরা বলছেন, অ্যাপনির্ভর পরিবহন সেবা চালু হওয়ায় ট্রিপ কমে এখন দিন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
Published : 20 Nov 2017, 08:03 AM
এই পরিস্থিতিতে অটোরিকশা মালিকদের বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধের দাবি করেছেন চালকরা। কেউ কেউ বলছেন, অবস্থার পরিবর্তন না হলে পেশা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাবেন।
এই অবস্থার জন্য অটোরিকশা চালকদেরই দুষছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান।
তিনি রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা যদি মিটারে যায়, যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বে যায় তাহলে যাত্রীরা অটোরিকশায় ঠিকই চড়বে। কিন্তু তারা তো গলাকাটা কাজ করে। এত এত জেল জরিমানা করার পরেও তাদের ঠিক করা যায়নি।”
অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধে দুই বছর আগে শ্রমিক, মালিকদের সম্মতিতে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ও দৈনিক জমার পরিমাণ পুনর্নির্ধারণ করে দেয় সরকার। ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ করা হলেও কিছু দিনের মধ্যেই মিটারে যেতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করেন চালকরা।
এর মধ্যে কয়েক মাস আগে ঢাকায় অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা ‘উবার’ চালু হওয়ার পর, তার মাধ্যমে প্রাইভেটকারে চলাচল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি পাঠাও, চলো, শেয়ার অ্যা মটরসাইকেল (স্যাম), আমার বাইক, আমার রাইড, ময়ুর, ওয়েজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের সেবা নিয়ে হাজির হয়।
অটোরিকশা চালকরা বলছেন, উবারে একটা ধাক্কা এসেছে, এরপর মটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং সেবাগুলো চালু হওয়ার পর তাদের যাত্রী কমেছে অনেক বেশি। একজন যাত্রী হলে বেশিরভাগ সময় মটরসাইকেলে চলে যায়। তাছাড়া ঢাকা জেলা ও প্রাইভেট অটোরিকশা চলাচল বেড়ে যাওয়ায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
অ্যাপনির্ভর এসব পরিবহন সেবা বন্ধসহ কয়েকটি দাবিতে ২৭ নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দিয়েছে সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।
তাদের এই কর্মসূচির পাল্টায় অটোরিকশা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন অনেকে। সিএনজি অটোরিকশা মালিক-চালকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা।
তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মগবাজার এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল সিদ্দিকী রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো সিএনজি অটোরিকশাওয়ালাদের কাছে জিম্মি ছিলাম। কোনো উপায় না থাকায় বেশি ভাড়া দিয়ে হলেও তাতে চড়তে হত।
“কিন্তু রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো আসায় আমাদের অনেকগুলো অপশন তৈরি হয়েছে। যখন চাইছি, তখনই চলে আসছে। আর ভাড়াও সাধ্যের নাগালে। এ কারণে এসব সেবা জনপ্রিয় হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে অটোরিকশা।”
অ্যাপভিত্তিক মটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা ‘পাঠাও’র প্রতিষ্ঠাতা হুসাইন ইলিয়াস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের ‘ইউজার’ হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন পাঁচ লাখ মানুষ।
“তবে এখন কতজন আমাদের রাইড শেয়ার করছে, এটা প্রকাশ করা যাবে না।”
স্যাম’র চেয়ারম্যান ইমতিয়াজ কাসেমের কাছেও এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা বের করা কঠিন। ব্যবসায়িক গোপনীয়তার কারণে কেউ এটা বলবে না। তবে রাইডের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।”
খিলগাঁও এলাকায় অটোরিকশাচালক শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অই সার্ভিস আওয়ার পরে আমরা তো মনে করেন খ্যাপ পাই না, পয়সাও পাই না। মটরসাইকেলে, প্রাইভেটকারে যায় গা সব প্যাসেঞ্জার। খুব বেশি ঠেহাত পড়ে হেরা আমাগো সিএনজিতে উঠে। এহন জমা তুইলা দুইশ তিনশ টেকা পাই কোনো দিন, কোনো দিন পাই না। মালিকরাও জমা কমায় না।”
শনিবার বিকালে কুড়িল বিশ্বরোডে অটোরিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন আবদুল হালিম। তিনি জানান, প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে বসে আছেন, কিন্তু কোনো যাত্রী আসছে না।
হালিম বলেন, ‘দেহেন না গাড়ি নিয়া ঘুরতাসি, খ্যাপ পাই না। কুড়িল মোড়ে দাঁড়াইয়া ছিলাম এক ঘণ্টা, এখন আবার এই দিকে ঘুরতাছি। জমাটমা দিয়া সারা দিনে দুই আড়াইশ ট্যাকার বেশি পাই না। ৫ হাজার ট্যাকা রুম ভাড়া দিয়া, বাজার কইরা পোষায় না। এ্যামনে চললে আমি তো বউ-বাচ্চা নিয়া গ্রামের বাড়ি যামুগা।”
রোববার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অটোরিকশা চালক তায়েব আলী বলেন, সকাল থেকে গাড়ি চালিয়ে এখন পর্যন্ত মালিকের জমার টাকা তুলতে পেরেছেন তিনি।
“রাস্তায় খ্যাপ অনেক কইমা গেছে। কিন্তু মালিকের জমা তো কমে নাই। এই টাইমে এইহানে খাড়াইলে কত খ্যাপ পাওয়া গেছে! এখন যেইডা কয় হেইডা লইয়াই যাইতে অয়। এই অবস্থায় আছি। আগে গাড়ির বাজার অনেক ভালো ছিল। অহন তো এই রকম না। বেতন উডাইতে আমার দম বাইর অইয়া যাইবগা।”
এ অবস্থায় অটোরিকশার জমা না কমালে পেশা পরিবর্তন ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানান চালক আশরাফুল আলম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মালিকরা এখন জমা নিতাছে ১ হাজার ট্যাকা। মালিক যদি ৩০০ ট্যাকা কম নিত তাইলেও চলতে পারতাম। তখন উবারওয়ালারা যেমনে ট্রিপ মারে আমরাও সেইভাবে মারতে পারতাম। জমা কমাইয়া না দিলে আমাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। যেই পরিস্থিতি অইছে এই গাড়ি চালান ছাইড়া দিতে অইব।”
অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা চালুর পর অটোরিকশার ট্রিপ কমেছে বলে স্বীকার করলেও জমার টাকা কমাতে রাজি নন মালিকরা।
ঢাকা মহানগর অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ বুলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আপাতত ভাড়া কমাচ্ছি না। চালকরা যেন ট্রিপ বেশি পায় আমরা সেদিকে যাচ্ছি।
“অবৈধভাবে চলাচলকারী অটোরিকশা চলাচল বন্ধে আমরা একটি রিট করেছিলাম হাই কোর্টে। আগামী সপ্তাহে এটার শুনানি হবে। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বৈধভাবে চলাচলকারী অটোরিকশার ট্রিপ এমনিতেই বেড়ে যাবে।”
রাজধানীতে বাণিজ্যিক অটোরিকশা প্রায় ১৪ হাজার। প্রায় ত্রিশ হাজার চালক এসব অটোরিকশা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা অটোরিকশা-অটোটেম্পু, মিশুক চালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক।