আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়া বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদকে গুলশানের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ১৮ দিনের মাথায় ওই ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
Published : 25 Jun 2017, 10:17 AM
গুলশান থানার এসআই খান নুরুল ইসলাম জানান, রোববার সকাল ৮টার পর রাজউক কর্মীরা গুলশান এভিনিউয়ের ১৫৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওই বাড়ি ভাঙা শুরু করেন। সন্ধ্যার আগে আগে সেই কাজ শেষ হয়।
রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালিউর রহমান সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আদালতের আদেশের পর বাড়ির দখল নিয়েছিলাম। সারা দিন কাজ করে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।”
চারটি বুলডোজার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে রাজউক কর্মীরা একতলা ওই ভবন ভাঙার কাজ করেন। জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি ট্রাকও সেখানে দেখা যায়।
বাড়ির বাইরে তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন বেশ কিছু পুলিশ সদস্য। দুপুরের আগে আগে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িও বাইরের রাস্তায় এনে রাখা হয়।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর গত ৭ জুন অভিযান চালিয়ে ওই বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এক বিঘা ১৩ কাঠা ১৪ ছটাক জমির ওপর ওই সম্পত্তির দাম রাজউক কর্মকর্তাদের হিসাবে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা।
সকালে রাজউক কর্মীরা কাজ শুরুর ঘণ্টা দুই পর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াও ঘটনাস্থল ঘুরে যান। তবে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি।
বাড়ি ভাঙা শুরুর পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, এভাবে বাড়ি ভাঙা ‘সম্পূর্ণ বেআইনি’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আদালতের কোনো নির্দেশ নাই এবং কোনো নোটিসও নাই। সবই তারা গায়ের জোরে করছে। আইনের চাইতে এখন শক্তি বেশি কার্য্কর।”
অন্যদিকে রাজউক কর্মকর্তা ওয়ালিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মওদুদ সাহেব নিজেই বলেছেন, তিনি এই বাড়ির মালিক নন, ভাড়াটে। তার মানে এই বাড়ির মালিক তিনি নন। আবার এই বাড়ির কোনো নকশাও আমরা রাজউকে পাই নাই। অনুমোদনহীন বাড়ি আমরা ভেঙে ফেলেছি।”
এই জমিতে রাজউক এখন কী করতে চায় জিজ্ঞেস করলে ওয়ালিউর রহমান বলেন, এখনও কোনো পরিকল্পনার কথা তার জানা নেই।
কথার লড়াই
রাজউকের অভিযান চলার মধ্যেই ওই বাড়ির ঠিক পেছনে গুলশানের ৫১ নম্বর সড়কে নিজের ফ্ল্যাটে সাংবাদিকদের সামনে আসেন মওদুদ। বাড়ির ব্যালকনি থেকে ভবন ভাঙার দৃশ্য তিনি সাংবাদিকদের দেখান।
মওদুদ বলেন, নোটিস না দিয়ে উচ্ছেদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দখলি স্বত্বে বিঘ্ন না ঘটানোর জন্য সরকার ও রাউজকের বিরুদ্ধে একটি দেওয়ানি মামলা করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে হাই কোর্টে আলাদাভাবে একটি রিট আবেদনও করেছেন।
আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় এভাবে বাড়ি ভাঙ্গা ‘বেআইনি’ বলে দাবি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মওদুদ।
“যেখানে বিষয়গুলো বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও এভাবে বলপ্রয়োগ করে, অস্ত্রের মাধ্যমে এবং জোর করে বাড়ি দখল করা এবং বাড়ি আজকে ভেঙে ফেলার যে অভিযান করছে, দুটোই মানবতাবিরোধী, মানবাধিকার বিরোধী, সংবিধান বিরোধী, আইনের বিরোধী।
“আদালতের নির্দেশ ছাড়া, কোনো নোটিস ছাড়া কাউকে উৎখাত করার কোনো আইন বাংলাদেশের মাটিতে নাই। কিন্তু তাদের কাছে এই আইন তুচ্ছ। এটাই প্রমাণ করে, এই সরকার আইনের প্রতি, আদালতের প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখায় না।”
“আমাদের অনেকগুলো মাল, অনেকগুলো জিনিসপত্র পড়ে আছে। এখনো ওই বিল্ডিংয়ে আছে। এটা আমরা আদালতে সাপ্লিমেন্টারি এফিডেফিট করে রেখেছি।
“আমরা এয়ারকন্ডিশনের খোলস পেয়েছি, কম্প্রেসার পাইনি। আপনারা এখনো দেখবেন ছাদের ওপর ছাদের বাইরে কম্প্রেসারগুলো লাগানো আছে। এগুলো তো আমাদের সম্পদ। এগুলো তো রাজউকের সম্পদ না।”
কামরুল হাসানসহ বিভিন্ন নামকরা শিল্পীর কিছু ‘দুর্লভ পেইন্টিংস’ ফেরত পাননি অভিযোগ করে মওদুদ বলেন, “এরকম অনেক কিছু… ৪৩টি। আমার আর আমার স্ত্রীর বইয়ের হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি আছে… এটা খুবই মূল্যবান। এই পাণ্ডুলিপিগুলোর একটাও পাইনি। এগুলো তো অমূল্য সম্পদ।”
দুপুরে নয়া পল্টনে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, সরকার নিজেদের ব্যর্থতা থেকে জনদৃষ্টি অন্যত্র সরাতেই মওদুদকে উচ্ছেদ করে ওই বাড়ি এভাবে ভেঙেছে।
“জনাব মওদুদ সাহেবের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনদৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়া। ঈদের আনন্দের মধ্যে সারা দেশে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর শোকের মাতমে বিপন্ন মানুষকে এদিকে ঠেলে, মানুষের চোখকে মওদুদ সাহেবের গুলশানের বাসার দিকে নিবদ্ধ করা হয়েছে; যাতে সরকারের চরম ব্যর্থতার দিকে মানুষের চোখ না পড়ে।
রিজভী বলেন, “মওদুদ সাহেবের গুলশানের বাড়িটিকে বেআইনিভাবে গুঁড়িয়ে দিতে যে আক্রমণ চালানো হয়েছে, আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির পক্ষ থেকে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ এই বাড়া ভাঙাকে অবৈধ বললেও রাজউকের কাজে কোনো ভুল দেখছেন না অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
দুপুরে মিন্টো রোডের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দীর্ঘ চার দশক মওদুদের ‘বেআইনি’ দখলে থাকা এই বাড়ি ভাঙতে ‘কোনো আইনি বাধা ছিল না’।
“আপিল বিভাগ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে- এই সম্পত্তিটা গ্রাস করার জন্য কাগজপত্রগুলি জাল জালিয়াতির আশ্রয়ে তৈরি করা হয়েছে। উনি কিছু মামলা করেছেন, সেটা উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে। এই মামলার করণে এই সম্পত্তি ভেঙে ফেলতে কোনো বাধা নিষেধ নাই।”
নোটিস না দেওয়ায় মওদুদের আপত্তি প্রসঙ্গে মাহবুবে আলম বলেন, “আদালতের রায়ের পর ওই বাড়ি এখন সরকারি সম্পত্তি। সুতরাং সরকার তা যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারে, সেজন্য নোটিসের প্রয়োজন নেই।”
মওদুদের দেখানো জিনিসপত্রের তালিকা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালিউর রহমান বলেন, “আমরা ওইদিন (৭ জুন) সবকিছু সরিয়ে নিয়েছি। এখন ওখানে বিল্ডিং ছাড়া আর কিছু নেই। সব জিনিস তিনি বুঝে নিয়েছেন, তার বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ৫১ নম্বর ও ৮৪ নম্বরের দুই বাড়িতে।”
আইনি লড়াই
গুলশান এভিনিউয়ের ওই বাড়ির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে তিনি ওই বাড়ির মালিকানা পান।
১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।
ওই বছরই মওদুদ বাড়িটির দখল নেন। কিন্তু ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির দখল নেওয়া হয়েছে অভিযোগ এনে দুদক মামলা করলে চার বছর আগে শুরু হয় আইনি লড়াই।
মওদুদ সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেলেও রায় তার বিপক্ষে যায়। তিনি আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ৪ জুন তাও খারিজ হয়ে যায়; ফলে মওদুদের বাড়ি ছাড়া অনিবার্য হয়ে পড়ে।
রায়ের দুই দিনের মাথায় ৭ জুন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে ওই বাড়ির দখল বুঝে নেয়।
সেদিন মওদুদের সামনেই ওই বাড়ি থেকে রাজউকের ট্রাকে করে মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয় গুলশানের দুটি বাড়িতে। মওদুদ নিজে পরে ৫১ নম্বর রোডে নিজের ফ্ল্যাটে ওঠেন।
পরে দেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দেন মওদুদ। জিয়া তাকে মন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী করেছিলেন।
জিয়ার মৃত্যুর পর মওদুদ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরেন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে তিনি মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন।
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মওদুদ বিএনপিতে ফেরেন এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
গত শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে স্বাধীনতা ফোরামের এক আলোচনা সভায় সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, “আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। কিন্তু তার মধ্যে একটা অন্যতম ভুল হল যে, আমি ক্ষমতার ব্যবহার করি নাই।”