ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় দুজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং জঙ্গি নেতা মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীসহ অন্য ছয় আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের সাজাই বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।
Published : 02 Apr 2017, 11:45 AM
ন্যায়বিচার পাইনি: রাজীবের বাবা
ব্লগ লিখেছে তো কী হয়েছে: আদালত
কারাদণ্ড পাওয়া আসামিদের শাস্তি বাড়াতে রাজীবের বাবা যে আবেদন করেছিলেন, তার পক্ষে কোনো আইনজীবী শুনানিতে না থাকায় তা খারিজ হয়ে গেছে।
নিম্ন আদালতের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এই রায় দেয়।
ঢাকার একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আলোচিত এ মামলায় আসামিদের যে সাজা দিয়েছিল, হুবহু তাই বহাল রাখা হয়েছে হাই কোর্টে।
হাই কোর্টেও সব আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায় না পেয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, এই রায়ে তিনি ন্যায়বিচার পাননি।
“সরকার বলে, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। এদেশের সরকার জঙ্গি দমনে বদ্ধপরিকর। কিন্তু আদালতে এসে তার প্রমাণ পাইনি। আদালতের রায়ে তার প্রতিফলন নাই।”
রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিরুল হক জহির সাংবাদিকদের বলেন, “এই মামলার যে তদন্ত হয়েছে, তা আরও সুষ্ঠু, সুনির্দষ্টভাবে হওয়া উচিৎ ছিল। তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তের ওপরই নির্ভর করে একটি ফৌজদারি মামলার প্রমাণের বিষয়টি। সেজন্য দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল, দায়বদ্ধ কর্মকর্তাদের তদন্তে নিয়োগ করতে পুলিশ প্রধানকে বলা হয়েছে।”
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর ১০ দিনের মাথায় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের কালশীতে নিজের বাসার কাছে চাপাতি হামলায় খুন হন আহমেদ রাজীব হায়দার।
গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব পেশায় ছিলেন একজন স্থপতি। উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির স্বরূপ উন্মোচনে অনলাইনে লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর উগ্রবাদী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত ছাত্র মিলে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
রাজীবের পর গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, ব্লগার, লেখক-প্রকাশক মিলে আরও কয়েকজনের হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহর সম্পৃক্ততা পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। এর মধ্যে কেবল রাজীব হত্যা মামলারই রায় এসেছে আদালতে।
>> রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম দীপ: মৃত্যুদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা।
>> মাকসুদুল হাসান অনিক: যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড।
>> এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ: ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড।
>> মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানী: পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে আরও দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড।
>> সাদমান ইয়াছির মাহমুদ: ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড।
আসামিদের মধ্যে রানা নিম্ন আদালতের রায়ের পর পলাতক থাকায় আপিল করার সুযোগ পাননি। কারাগারে থাকা বাকি সাতজনই আপিল করেন।
ফাঁসির আসামি রানা হাই কোর্টে এ মামলার শুনানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
রাজীব হত্যা মামলায় তিন বছরের সাজা খেটে গতবছর ২১ জুলাই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হওয়ার পর সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এক মামলায় আবারও গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আসামিদের দেওয়া সাজার ব্যাখ্যায় নিম্ন আদালত বলেছিল, দীপের চাপাতির আঘাতে রাজীবের মৃত্যু হয়। এ কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অনিক সেই চাপাতি কিনে এনেছিলেন বলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় নিম্ন আদালত।
আর হাকিমের কাছে দেওয়া সাদমান ইয়াসির মাহমুদের ‘জবানবন্দির ভিত্তিতে’ তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়।
দুই বছর আগে দেওয়া ওই রায়ে বলা হয়, মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানী যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে হত্যাকাণ্ডে তার নিজের বা অন্য আসামিদের কারও সম্পৃক্ততার কথা আসেনি।
“তবে তার খুৎবায় অনুপ্রাণিত হয়েছে এ সব আসামিরা। যে কারণে তার বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ আসে। তার শাস্তি পাঁচ বছরের।”
নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয়, “আসামিপক্ষ থেকে কেউ সাজা কমানোর দাবি করেনি; সবাই খালাস চেয়েছেন। কিন্তু খালাস দেওয়ার মতো কাউকে পাইনি। হত্যায় অংশগ্রহণের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
হত্যায় উসকানিদাতা হিসেবে মুফতি রাহমানীর যে দণ্ড হয়েছিল, তাতে অসন্তোষ জানিয়ে রাজীবের বাবা নাজিম উদ্দিন বলেছিলেন, রায়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। এ কারণে কারাদণ্ড পাওয়া আসামিদের শাস্তি বৃদ্ধির জন্য ক্রিমিনাল রিভিশনের আবেদন করেন তিনি।
কিন্তু ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি করে নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে হাই কোর্ট।
রাজীবের বাবার আবেদন খারিজ করে দিয়ে হাই কোর্ট বলেছে, ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির সময় ওই পক্ষের কোনো আইনজীবী আদালতে ছিলেন না।তাছাড়া বাংলাদেশের বিচারের ইতিহাসে উচ্চ আদালতে এসে সাজা বাড়ার নজির খুব বেশি নেই।
রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় হাই কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “একজন ইমামের দায়িত্ব হল নামাজ পড়ানো এবং ইসলামের জ্ঞান মুসল্লিদের দেয়া। ইমাম সাহেবরা এমন কোনো বয়ান দেবেন না যেটা প্রচলিত আইন বহির্ভূত।”
আদালত বলেছে, যদি কেউ ইসলাম, নবী (স.) কিংবা অন্য কোনো ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন বা ফেইসবুকে পোস্ট দেন, তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।
“এই হত্যা মামলার এভিডেন্স ও আরগুমেন্ট থেকে দেখা যায়, মুফতি রাহমানী বাদে বাকি সাত জন মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্ট। কিন্তু তারা কেন এই পথে গেলেন সেটা আমরা খুঁজে পাইনি। অবশ্য এ পথে যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে।”
সন্তানদের ‘সঠিক পথে রাখতে’ অভিভাবকদের আরও বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে হাই কোর্টের এই রায়ে।
আদালত বলেছে, “আমাদের অনেক গার্ডিয়ান নিজেদের লাইফস্টাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাচ্চাদের মানসিকতা বিবেচনায় না নিয়ে অ্যারিস্টোক্রেসি মেনটেইন করার জন্য যে কোনো পড়াশোনা তাদের উপর আমরা চাপিয়ে দিই।”
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, আজকের তরুণরা বা মেধাবী ছেলেরা কেন বিপথগামী হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে সামাজিক শক্তিগুলোকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে রায়ের পর্যবেক্ষণে। সন্তানদের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সময় দিতে, তারা যেন ভালভাবে গড়ে উঠতে পারে সেজন্য সচেষ্ট থাকতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
“ছেলেমেয়েদের চরিত্র গঠনে এবং সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শরিয়াভিত্তিক আলোচনা করার জন্য দেশের ইমামদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আদালত।”
# ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের কালশীতে আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
# হত্যাকাণ্ডের পর রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন পল্লবী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
# তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত ছাত্রকে সেখানে আসামি করা হয়।
# ২০১৪ সালের ১৮ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার আসামিদের বিচার শুরু করে আদালত।
# ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহম্মেদ ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করেন। দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্যদের কারাদণ্ডাদেশ দেন তিনি।
# পলাতক আসামি রানা বাদে অন্যরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন। পাশাপাশি দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) হাই কোর্টে যায়। রাজীবের বাবা নাজিম উদ্দিন কারাদণ্ডের আসামিদের সাজা বাড়ানোর জন্য ক্রিমিনাল রিভিশন দায়ের করেন। হাই কোর্টে শুনানি শুরু হয় গত বছরের ৭ নভেম্বর।
# গত ৯ জানুয়ারি আপিল শুনানি শেষে হাই কোর্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। এরপর গত সোমবার রায়ের জন্য ২ এপ্রিল দিন ঠিক করে দেওয়া হয়।
# হাই কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির। আসামিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুর রেজাক খান ও মো. আহসান উল্লাহ।