ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া পলাতক আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ভুয়া ঠিকানায় পাসপোর্ট বানিয়ে মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর গত প্রায় তিন বছর ধরে সেখানে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
Published : 20 Feb 2017, 09:58 PM
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেশটির কর্তৃপক্ষ রানাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। সোমবার দুপুরে ঢাকার উত্তরা থেকে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের এই সংগঠককে আশরাফ নামের এক সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
জঙ্গিবাদ দমনে সক্রিয় পুলিশের এ ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলছেন, মালয়েশিয়া যাওয়ার পর রানা ‘আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে’ ব্যর্থ হন। পরে ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে’ ফিলিপিন্সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতির মধ্যেই মালয়েশিয়ার গোয়েন্দারা তাকে গ্রেপ্তার করে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবীতে ব্লগার রাজীবকে তার বাসার কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রানার পরিকল্পনায় ওই হত্যাকাণ্ড হয় বলে পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে।
পেশায় স্থপতি রাজীব ব্লগ লিখতেন ‘থাবা বাবা’ নামে, যেখানে ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে লিখতেন তিনি।
অন্যদিকে রানা ও তার সহযোগীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীর ‘বই পড়ে এবং তার বয়ান ও খুতবা’ শুনে ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ খুন করতে উদ্বুদ্ধ হন বলে ওই মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
নিম্ন আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে সাত আসামির আপিলের রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে। পলাতক থাকায় রানা হাই কোর্টে আপিল করার সুযোগ পাননি।
সোমবার দুপুরে রানা গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল।
তিনি বলেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্র রানা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে ‘কয়েকটি সেল গঠন করে’ দেশে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। তেমনই একটি ‘সেল’ ব্লগার রাজিব হায়দারকে হত্যা করে। অন্য একটি সেল ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে তাকে জখম করে। ওই মামলাতেও রানা অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।
“২০১৩ সালের শেষ দিকে এ দলের দুইজন মিরপুরের একটি স্কুলের একজন সহকারী প্রধান শিক্ষককে হত্যার জন্য যাওয়ার সময় পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। সেখানে একজন গ্রেপ্তার হয়, অন্যজন পালিয়ে যায়। যে গ্রেপ্তার হয়েছিল সে জিজ্ঞাসাবাদে রানার ছবি দেখে বলেছিল, তাদের দুইজনকে রানাই হামলার জন্য প্রস্তুত করেছিল।”
মনিরুল জানান, ওই বছরের শেষ দিকে রাজীব হত্যায় রানার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়ার পর তার দেশত্যাগ ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহ করে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনকে তা জানানো হয়েছিল। কিন্তু রানা ভুয়া ঠিকানা দিয়ে নতুন পাসপোর্ট তৈরি করে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় চলে যান।
“তার বাড়ি ফেনীতে হলেও গাজীপুরের মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে তিনি পাসপোর্ট তৈরি করেন। তবে সেখানে নিজের নাম, বাবা-মা ও জন্মতারিখ ঠিক রাখেন।”
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এরপর মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার গোয়েন্দারা তাকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় বলে জানান মনিরুল।
তিনি বলেন, এক সময় আনসারউল্লাহর সংগঠকের ভূমিকায় থাকা রানা মালয়েশিয়ায় গিয়ে আরেক জঙ্গি জুন্নুন শিকদারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
গুলশানের জঙ্গি হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ ১০ যুবকের যে প্রথম তালিকা দেওয়া হয়, সেখানেও জুন্নুনের নাম ছিল।
অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল বলেন, জুন্নুন পরে মালয়েশিয়া থেকে সিরিয়ায় চলে যান এবং তার মাধ্যমেই রানা আইএসের প্রতি আকৃষ্ট হন বলে তারা জানতে পেরেছেন।
“সেখানে রানা বাইয়াত নেন এবং সিরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। সিরিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে তিনি তার সহযোগী আশরাফসহ ট্রেইনিং নিতে ফিলিপিন্সে যাওয়ার জন্য আবু সায়াফ নামের একটি জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার মধ্যেই মালয়েশিয়ার গোয়েন্দারা তাদের গ্রেপ্তার করে।”
কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশের প্রধান বলেন, “তিনটি ঘটনায় রানার সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়। ব্লগার হত্যার অন্য ঘটনাতেও তার ইন্ধন থাকতে পারে। তাকে রিমান্ডে পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।”
সোনাবাহিনীর বরখাস্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার সঙ্গে রানার কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, “তার কাছ যেসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস পাওয়া গেছে এবং যে ধরনের লিটারেচার পাওয়া গেছে তাতে তার বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা হবে। আদালত থেকে তাকে রিমান্ডে পাওয়া গেলে হলি আর্টিজান হামলায় জড়িত নর্থ সাউথের নিবরাজ ইসলাম বা অন্য কারও যোগাযোগ ছিল কিনা- সেটা জানার চেষ্টা করা হবে।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, তাদের ‘জানা মতে’, রানার আগের পাসপোর্ট এমআরপি ছিল না। কীভাবে তিনি ভুয়া ঠিকানা দিয়ে পাসপোর্ট পেলেন, সেখানে পুলিশের কারও গাফিলতি ছিল কি না, পাসপোর্ট অফিসের কেউ জড়িত ছিলেন কিনা- সেসব বিষয়ও তদন্ত করে দেখা হবে।
“আমাদের জানা মতে, রানার পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে কোনো আপিল হয়নি। নতুন মামলা করে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা করা হবে। মঙ্গলবারই তাকে আদালতে পাঠিয়ে দশ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হবে।”