বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) সংশোধনে এক যুগ আগে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের রায় জানা যাবে ২৪ মে।
Published : 17 May 2016, 01:50 PM
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি নিয়ে রায়ের এই দিন ঠিক করে দেয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। অন্যদিকে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টর এম আমীর-উল ইসলাম, সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন।
মুরাদ রেজা পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুনানি শেষ হয়েছে, আদালত ২৪ মে রায়ের দিন রেখেছেন।”
মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করার পর ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ-কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে।
সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করে। তার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাই কোর্ট এ বিষয়ে কয়েকদফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়।
রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে প্রচলিত বিধি সংশোধন করার পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয় সরকারকে।
রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে ২০০৪ সালে তা মঞ্জুর হয়। তবে হাই কোর্টের নির্দেশনা সে সময় স্থগিত করা হয়নি।
এর ধারাবাহিকতায় গত ২২ মার্চ আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়।
হাই কোর্টের নির্দেশনা
ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না।
খ. কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
গ. গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে।
ঘ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।
ঙ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
চ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন।
ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।
ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
এসব নির্দেশনা ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল হাই কোর্টের সেই রায়ে।
শুনানিতে দুই পক্ষ
শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “শুনানিতে আমরা বলেছি, অপপ্রয়োগের ব্যাপারে আদালত যদি কোনো রকম নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয় সেটা ঠিক আছে, কিন্তু আদালত আইন সংশোধনের জন্য ছক করে দিয়ে কোনো রকম অর্ডার দিতে পারেন না।”
৫৪ ধারার মূল বক্তব্য আসামিদের সুরক্ষা- এমন দাবি করে রাষ্ট্র্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “সমাজে সাধারণ মানুষ ও আসামি উভয়েই বসবাস করে। অপরাধের ফলে যারা ভিকটিম হয়, তাদের কিন্তু অধিকার আছে, আসামিরও একটি অধিকার আছে। আদালতের কাজ হল এই দুটির ভেতরে ব্যালেন্স করা।”
মাহবুবে আলম বলেন, দেশে এখন যেভাবে জঙ্গিবাদি কার্যক্রম, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে হামলা এবং গুপ্ত হত্যা হচ্ছে, তাতে শক্তভাবে আইনের প্রয়োগ না করে কেবল আসামির অধিকার ‘প্রকটভাবে দেখা হলে’ সমাজে আইন-শৃঙ্খলার আরও অবনতি ঘটবে।
ব্লাস্টের আবেদনে হাই কোর্ট যে রায় দিয়েছে, সেটি ‘আইন সম্মত হয়নি’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে বলা হয়েছে- যেসব আইন মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি, সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে। তার পরও ব্রিটিশ আমলের পুরানো পুলিশ অ্যাক্ট, ফৌজদারি কার্যবিধির কিছু ধারা চালু আছে, যেগুলো মৌলিক অধিকার ও আধুনিক চিন্তা-চেতনার বিরোধী।
“হাই কোর্টের রায়কে দেখতে হবে আমাদের সংবিধানের আলোকে, কেননা মৌলিক অধিকার পরিপন্থি বিষয়গুলো ইতোমধ্যে আইনের চোখে, সংবিধানের চোখে ও হাই কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে অকেজা হয়ে গেছে। সেগুলো পরিবর্তন করে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।”
ব্যারিস্টার আমীর বলেন, “যখন অপারেশন ক্লিন হার্ট হল, তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যখন জননেত্রী শেখ হাসিনার বাসা থেকে ফিরছিলেন, তখন তাদের গ্রেপ্তার করে মাসের পর মাস বন্দি করে রাখা হয়েছিল বিভিন্ন রকম মিথ্যা মামলা দিয়ে। তখনও এটি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম আমরা। তখন রায় পেয়েছিলাম।
“আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিমকেও ওইভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহারিয়ার কবির ও মুনতাসীর মামুনকে অত্যচার করা হয়েছে। ওই সময় সাংবাদিকদের জন্য আমাদেরকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি না করার নির্দেশনা চাইতে হত।”
শুনানির প্রথম দিন হাই কোর্টের এসব নির্দেশনা তুলে ধরে রিটকারীর পক্ষে ড. কামাল হোসেন আদালতে বলেন, “প্রায় ১৩ বছর আগে আদালত এসব নির্দেশনা দিয়েছে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই।”
পরে আদালত থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও ডিটেনশনের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশনা সেইফ গার্ড। হাই কোর্টের নির্দেশনা যদি বাস্তবায়ন করা হতো, তাহলে হেফাজতে নাগরিকের মৃত্যুর খবর আসত না।”