বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে পরিচালিত অভিযানকে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।
Published : 13 Sep 2015, 03:34 PM
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এ রায় দেয়।
এতে বলা হয়, যৌথবাহিনীর ওই অভিযানের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ফৌজদারি ও দেওয়ানী মামলা করতে পারবে এবং হাই কোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর ওই অভিযান চলে।
প্রায় চার মাসের ওই অভিযানে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয় বলে গণমাধ্যমের তথ্য, যারা সবাই হৃদেরাগে মারা গিয়েছিলেন বলে সে সময় যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল।
ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ করা হয়।
এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ২০১২ সালের ১৪ জুন হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৯ জুলাই বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ রুল দেয়।
রুলে ওই আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না—তা জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়।
আইন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রসচিব, সেনা সদর দপ্তরের কমান্ডার ইন চিফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে এর জবাব দিতে বলে হাই কোর্ট।
এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ৩১ অগাস্ট আদালত রায়ের জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করে দেন।
আদালতে রিট আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এম মনজুর আলম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
রিট আবেদনকারীর যুক্তি, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করেছে। এর ১৪ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কেউ নির্যাতিত হলে ও এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ প্রদানে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।
আবেদনকারী বলেন, “নির্যাতিত হবে, খুন হবে কিন্তু প্রতিকার চাওয়া যাবে না—এর চেয়ে কালো ও খারাপ আইন হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত যে কোনো হত্যাকাণ্ড আইনের শাসনের পরিপন্থি।”
ওই আইনের ৩(ক) ধারায় বলা হয়, “২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সকল আদেশ, উক্ত আদেশসমূহ বাস্তবায়নে যাবতীয় কাজ এবং এর অধীনে যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কেউ ওই সময়ে দায়িত্ব বিবেচনায় প্রদত্ত আদেশ, আটক, গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদসহ সকল প্রকার কার্য ও গৃহীত ব্যবস্থা, প্রচলিত আইনে ও আদেশসমূহে যাই থাকুক না কেন, আদেশ প্রদানকারী এবং উক্ত আদেশ পালনকারী এবং কার্য সম্পাদনকারী এবং যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণকে সর্বপ্রকার দায়মুক্ত করা হইল।”
৩(খ) ধারায় বলা হয়, “ওই আদেশে কারও প্রাণহানি, জান-মালের কোনো ক্ষতি বা কারও অধিকার ক্ষুণ্ন হলে বা কেহ আর্থিক, শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কেহ অন্য কোনভাবে সংক্ষুব্ধ হলে আদেশ প্রদানকারী বা কার্য নির্বাহীর বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো প্রকার দেওয়ানি বা ফৌজদারি মোকদ্দমা বা কার্যধারা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা চলিবে না।”
আইনের এই ধারাগুলো সংবিধানের প্রাধান্য নিয়ে ৭ অনুচ্ছেদে সংবিধানের প্রাধান্য, ২৬ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল, ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ৩১ অনুচ্ছেদ আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার, ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষণ, ৩৩ অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ এবং ৪২ অনুচ্ছেদে সম্পত্তির অধিকার বিষয়ক বিধানের পরিপন্থি অভিযোগ করে এই রিট আবেদন করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, “দায়মুক্তি দিয়ে যৌথবাহিনীকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিল। সেই আইনটাকে বাতিল করেছে, সম্পূর্ণ আইন বাতিল করা এর মধ্যে হয় নাই।”
তিনি বলেন, “আদালত বলেছেন, যতবড় অপরাধী হোক না কেন, পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাজ হল তাকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলা করে বিচার করা। জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেফাজতে নিয়ে তাকে যে নির্যাতন করা হয়, সেটা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং এই আইনের বাইরে কাজ করার ক্ষমতা সংবিধান বা আইন কাউকে দেয় নাই।”
এক প্রশ্নের জবাবে শাহদীন মালিক বলেন, “৪০টি পত্রিকার কাটিং দিয়েছিলাম। পত্রিকার কাটিংয়ে দেখা গেছে, ৫৭ জন ব্যক্তির এভাবে হেফাজতে মৃত্যু হয়েছিল, যাদের ওই সময় যৌথ বাহিনী বলছে, তারা ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা গেছে।”
রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তৎকালীন সংসদ দায়মুক্তির একটা আইন পাস করেছিল। যার কারণে ওই সময়কালে কেউ কোর্টে আশ্রয় নিতে পারেনি বা থানায় গিয়েও সুবিচার প্রার্থনা করতে জিডি বা মামলাও করতে পারেনি।
“এই রায়ের ফলে সেই দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। ওই সময়কালের ঘটনা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ফৌজদারি বা দেওয়ানি আইনে মামলা করতে পারবে।”
“১০০ কোটি টাকার তহবিল বিষয়ে রুল হলেও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, ফৌজদারি দায় হচ্ছে ব্যক্তিগত দায়। আদালত এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার দেয়নি,” বলেন তিনি।