কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর খুনি গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বুধবার সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক ঘণ্টা বন্ধ রাখার ডাক দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
Published : 27 Mar 2016, 07:05 PM
এক সপ্তাহেও খুনি গ্রেপ্তার না হওয়ায় দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে রোববার সকালে ঢাকা থেকে রোড মার্চ শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটি।
পথে পথে সাধারণ মানুষের সাড়া নিয়ে বিকালে কুমিল্লায় পৌঁছে কান্দিরপাড়ে এক সমাবেশে এই আহ্বান জানান মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
রোববার সকালে ঢাকা থেকে রোড মার্চ করে বিকালে কুমিল্লায় পৌঁছে কান্দিরপাড়ে আন্দোলনরতদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের সমাবেশে এই ডাক দেন মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
তিনি বলেন, “সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষক ও খুনিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ৩০ মার্চ বুধবার সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেলা ১২টা থেকে এক ঘণ্টা বন্ধ থাকবে।
“এই ঘণ্টায় সারাদেশের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনে বিচার দাবিতে মানববন্ধন করবেন।”
কুমিল্লা সেনানিবাসের মধ্যে ভিক্টোরিয়া কলেজের এই ছাত্রীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
কুমিল্লায় চলছে ধারাবাহিক কর্মসূচি। রোববার তনুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনকারীরা পদুয়ার বাজারে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও অবরোধ করে।
তাদের এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় এক পথসভায় ইমরান বলেন,“কুমিল্লাবাসীর মতো সারা দেশের মানুষ আজ মাঠে নেমেছে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে খুনিরা যতই শক্তিশালী হোক নিস্তার পাবে না।”
বুধবারের কর্মসূচিতে সবাইকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কান্দিরপাড়ের সমাবেশে ইমরান বলেন, “আমরা তনু হত্যার বিচার দাবিতে মাঠে নেমেছি। এর বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না।”
“অবিলম্বে তনুর খুনি ও ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করা হোক। তাদেরকে এমন শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে তনুর এ ঘটনা সারাদেশের সকল খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে,” দাবি জানান তিনি।
গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় নিজের বাসার কাছে খুন হন নাট্যকর্মী তনু। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তনুর বাবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কর্মচারী ইয়ার হোসেন একটি মামলা করলেও কোনো খুনিকে শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এক সপ্তাহ পর মামলাটি তদন্তের ভার চেপেছে ডিবির উপর।
দেশজুড়ে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, এই কলেজছাত্রীর খুনের রহস্য দ্রুতই উদ্ঘাটিত হবে বলে তিনি আশা করছেন।
নানা প্রশ্ন ওঠার মধ্যে সেনা কর্তৃপক্ষ খুনি গ্রেপ্তারে পুলিশকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
ইমরান বলেন, “সেনানিবাসের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে তনুকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে। যেখানে সন্ধ্যার পর কোনা সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকে না।”
তনু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি শুক্রবার এসেছে, তাতে বলা হয়েছে, সেনানিবাসের যে অলিপুর এলাকায় হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে, সেখানে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই।
ইমরান বলেন, “আমাদের আন্দোলন কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের আন্দোলন কয়েকজন খুনি ও ধর্ষকের বিরুদ্ধে।
“আমাদের যে সেনাবাহিনী সারাবিশ্বের নানা প্রান্তে শান্তিরক্ষার কাজ করে সে সেনাবাহিনীর গায়ে কোনা রক্তের দাগ, খুন-ধর্ষণের দাগ থাকুক, সেটা আমরা চাই না। আমরা চাই, সেনাবাহিনী নিজেরা এদের খুঁজে বের করবে।”
“আমরা সেনাবাহিনীর কাছ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা চাই, তারা তনুর ঘটনায় জিরো টলারেন্স দেখিয়ে সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করবে।”
১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা পরবর্তী সময়ে গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনজন পুলিশ সদস্যের ফাঁসির প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন গণজাগরণের মুখপাত্র।
“ইয়াসমিনের ঘটনার সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে আমরা রাস্তায় নেমে বিচার চাইতে দেখেছি। এবারের ঘটনায় আমরা তার কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে বক্তব্য প্রত্যাশা করছি।”
ঢাকা থেকে সকালে রওনা হয়ে বিকালে কুমিল্লা শহরে ঢোকার আগে সেনানিবাস ফটকের কাছে পথসভা করে গণজাগরণ মঞ্চ।
তনুর খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে কুমিল্লার আলেখার চর, পদুয়ার বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ হলেও হত্যাকাণ্ডস্থল সেনানিবাসের কাছে সমাবেশ এটাই প্রথম বলে এলাকাবাসী জানায়।
রোডমার্চকারীরা বেলা সোয়া ৩টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড জামে মসজিদের সামনে নেমে সমাবেশ করতে চাইলে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দেয়।
আন্দোলনকারীরা সেখানে স্লোগান তোলেন ‘ক্যান্টনমেন্টের ভয় দেখিয়ে, দমিয়ে রাখা যাবে না’, ‘ক্যান্টনমেন্টে বোন মরে, সেনারা কী করে’, ‘আমরা তনুর বোন-ভাই, তনু হত্যার বিচার চাই’।
তখন পুলিশের সঙ্গে কথা বলে গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা সেখান থেকে সরে সেনানিবাসের পূর্বদিকের ফটকের কিছু দূরে ইস্টার্ন ট্রেডিং কর্পোরেশন ফিলিং স্টেশনের সামনে সমাবেশ করে।
আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার সোলায়মান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “ক্যান্টনমেন্টের সামনের এ এলাকায় গাড়ি প্রচুর চাপ ছিল, সেজন্য তাদেরকে সামনের দিকে সমাবেশ করতে বলা হয়।”
সেখানে সমাবেশের সূচনা বক্তব্যে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক জীবনানন্দ জয়ন্ত বলেন, “আমরা এমন এক ক্যান্টনমেন্টের সামনে এসে এখন দাঁড়িয়েছি, যেই ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা বেষ্টনি আমাদের বোন তনুকে সুরক্ষা দিতে পারেনি। আমাদের বোনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।”
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার বলেন, “তনু হত্যার বিচার দাবির আন্দোলনকে হুমকি দিয়ে প্রভাবশালী মহল থেকে শুরু করে নানাজন বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে। আবার ২০ হাজার টাকা আর খাস জমির লোভ দেখিয়ে মানুষের নজর অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টাও হয়েছে।
“আমরা ধিক্কার জানাই। আমরা নগদ টাকা, খাস জমি চাই না। আমরা ন্যায়বিচার চাই। ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেই ঘরে ফিরতে চাই।”
কান্দিরপাড়ের সমাবেশে রোডমার্চে আসা অন্যদের মধ্যে ভাস্কর রাশা, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি ইমরান হাবিব রুমন বক্তব্য দেন।
সকাল ১০টার দিকে শাহবাগ থেকে রোডমার্চ শুরুর পর চিটাগাং রোড, কাচপুর, গৌরীপুর, মাধাইয়া ও চান্দিনা বাসস্ট্যান্ডে পথসভা করে কুমিল্লায় পৌঁছায় গণজাগরণকর্মীরা।
আলেখারচরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পথসভার পর কুমিল্লা শহরের কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড়ে পৌঁছায় রোডমার্চকারীরা।
পথসভাগুলোতে অনেক মানুষ রোডমার্চকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারা স্লোগান তোলে- ‘আমরা তনুর বোন-ভাই, তনু হত্যার বিচার চাই’।
নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের পথসভায় স্কুল-কলেজের পোশাকে কিছু শিক্ষার্থীকেও পথসভায় অংশ নিতে দেখা গেছে।
ছয়টি বাসে মঞ্চের নেতাকর্মীরা রোডমার্চে যান। সামনে একটি পিকআপ ভ্যানে চলে কর্মীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও স্লোগান।
রোডমার্চ শুরুর আগে ইমরান শাহবাগে সমাবেশে বলেন, “এই হত্যার বিচার দাবিতে কুমিল্লার সাধারণ মানুষের যে আন্দোলন, তাকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত এবং আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
“এই রোডমার্চের মাধ্যমে আমরা কুমিল্লার মানুষের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করে তাদের কাছে সারাদেশে আন্দোলনের বার্তা নিয়ে যেতে চাই। আমরা জানিয়ে দিতে চাই, খুনী-ধর্ষকরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।”