পৌর নির্বাচনে অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাচন কমিশন ৩১টি অভিযোগ শনাক্ত করে মাত্র একটির তদন্তে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। বাকিগুলো ‘সত্যতা ও যথার্থতা’ যাচাইয়ের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
Published : 17 Dec 2015, 07:40 AM
এর প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিধি লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয়ে নজরে এলে তাৎক্ষণিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার ইসির রয়েছে। এক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ছেড়ে দেওয়া অনেকটা ‘দায়’ এড়ানোর মতো।
নির্বাচনী ডামাডোলে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে কোনো সময়সীমা বেঁধে না দিয়ে সব অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠানোর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না বলেও মনে করেন সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২৩৪ পৌরসভায় ভোট হবে। মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ১২ হাজারেরও বেশি প্রার্থী এখন প্রচারণায় ব্যস্ত। আচরণবিধি প্রতিপালন তদারকিতে মাঠে রয়েছে নির্বাহী হাকিমও।
আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, যে কোনো উৎস থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে বিধি লঙ্ঘন করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন- এমন প্রতীয়মান ইসি বিষয়টি তদন্তে সম্পর্কে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিতে পারবে। বিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইসি সন্তুষ্ট হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারে।
পৌর নির্বাচনের বিধি লঙ্ঘন সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির সভাপতি রকিব উদ্দিন মন্ডল বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত অন্তত ৩১টি অনিয়ম-বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়েছেন তারা।
“এর মধ্যে ৩০টি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে ‘তদন্তের মাধ্যমে সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা’ নিতে বলা হয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হল, তা ইসি সচিবালয়কে অবহিত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি বলে স্বীকার করেন ইসির এ উপ সচিব।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৩ ডিসেম্বর চাটখিলের বিএনপির এক প্রার্থীকে জোর করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগটি শুধু তদন্ত করছে ইসি।
নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গণমাধ্যম ও লিখিত আকারে পাওয়া ৩০টি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানোয় কার্যকর কিছু হওয়া নিয়ে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও সংশয় রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢালাও অভিযোগের বিষয়ে ইসি স্বয়ং অনীহা প্রকাশ করে। এখন কোনো কিছু যাচাই না করে শুধু অভিযোগ আমলে নেওয়ার মতো করে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠিয়ে কোনো কাজ হবে না। কারণ, কোনো সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়নি তাদের।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এভাবে গড়পড়তা অভিযোগ রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে ছেড়ে দেওয়া অনেকটা দায় এড়ানোর মতো।
“রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তারাও ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু ইসি কোনো ব্যবস্থা নিতে না বলে তাদের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।”
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে এভাবে নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনিও। তার মতে, মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বেগ পেতে হবে।
“আগের কিছু নির্বাচনেও বলার মতো কিছু করা হয়নি। দৃষ্টান্ত ইসি থেকে দেখাতে হবে। এখন পর্যন্ত সে রকম কিছু করতে পারেনি বর্তমান ইসি, যাতে মানুষের আস্থা বাড়বে কমিশনের প্রতি। ইফেকটিভ কিছু কমিশন থেকে করতে হবে। যাতে রিটার্নিং কর্মকর্তারা সাহস পান,” বলেন ২০০৭-২০১১ সালে নির্বাচনের কমিশনারের দায়িত্বে থাকা ছহুল।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কোনো অভিযোগই হালকাভাবে নিচ্ছি না। সব কিছু খতিয়ে দেখতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বলেছি। তাদের বেশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।”
কোনোভাবে ‘দায়’ এড়াতে এ ধরনের নির্দেশনা মাঠ কর্মকর্তাদের দেওয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগও নাকচ করেন তিনি।
মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় উপস্থিতি ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য ইতোমধ্যে তিন সাংসদকে শোকজ করে ইসি। সরকার দলীয় সাংসদরা এর জবাবও দিয়েছেন।
কিন্তু দুই মন্ত্রীর বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে যাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ায় সমালোচনার মুখেও পড়ে ইসি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনের সময়ও এ ধরনের অভিযোগ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছিল ইসি। এর কোনোটিই শেষ পর্যন্ত আমলে নেয় নি ইসি। অনেক রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেছিলেন, গণমাধ্যমে ‘অতিরঞ্জিত’ সংবাদ এসেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ভোটের পর অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ এলেও তা আমলে নেয়নি ইসি।
তবে দশম সংসদ নির্বাচনে ইসি স্বউদ্যোগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দুজন সাংসদের গেজেট আটকে রেখেছিল। তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে গেজেট প্রকাশের সম্মতি দেয় ইসি।
৩০ রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চিঠি
ইসির উপ সচিব রকিব উদ্দিন মন্ডল জানান, ২২টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও আটটি লিখিত অভিযোগ যথাযথ যাচাই করে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা ইসিকে অবহিত করার জন্যে ৩০ জন রিটার্নিং অফিসারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এর মধ্যে নোয়াখালীর চৌমুহনী, চাঁপাইনবাগঞ্জের রহনপুর, সিলেটের গোলাপগঞ্জ, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ (২টি অভিযোগ), হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, ঢাকার সাভার ও ধামরাই, চাঁদপুরের কচুয়া, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, ফেনীর পরশুরাম, সদর ও দাগনভুঞা, নড়াইল সদর ও কালিয়া (দুটি অভিযোগ), মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম, চাঁদপুরের ছেংগারচর, ঝিনাইদহের মহেশপুর, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, রাজবাড়ির গোয়ালন্দ পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন পাঠিয়ে সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া কুমিল্লার লাকসাম, চাঁদপুরের কচুয়া, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর তাহেরপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহের গৌরিপুর, সাভার ও জামালপুরের ইসলামপুর পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তাদের লিখিত অভিযোগগুলো পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।