রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলমুক্ত করার দাবিতে মঙ্গলবার হবে সাইকেল শোভাযাত্রা, অনশন।
Published : 26 Sep 2022, 09:44 PM
বানিয়াচং থেকে উঠে আসা ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস একদিন বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করে যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন, তার বসতভিটা দখলমুক্ত করার দাবি নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বানিয়াচংবাসীর আরেক ইতিহাস তৈরির অঙ্গীকার ধ্বনিত হল।
রামনাথ বিশ্বাসের আদি বাড়ি দখলমুক্ত করার দাবিতে নানা কর্মসূচি শুরুর আগে সোমবার হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ১ নম্বর বানিয়াচং উত্তর-পূর্ব ইউনিয়ন পরিষদের সভা কক্ষে এই মতবিনিময় সভা হয়।
সভা থেকে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ির দখলদারদের হামলায় রাজীব নূরসহ সাংবাদিকদের আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ ও দুঃখও প্রকাশ করা হয়।
বাইসাইকেলে বিশ্বভ্রমণকারী রামনাথ বিশ্বাস ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে সেখানেই তিনি মারা যান। এরপর তার হবিগঞ্জের বাড়িটি বেদখল হয়ে পড়ে। আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া নামে এক ব্যক্তি এখন বাড়িটির দখল নিয়ে আছেন।
সম্প্রতি ওই বাড়ি দেখতে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজীব নূরসহ সাংবাদিকরা দখলদারদের হামলার শিকার হওয়ার পর ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচনা তোলে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িটি দখলমুক্ত করার দাবি তুলেছে বিভিন্ন সংগঠন। গঠিত হয়েছে ‘ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি’, যাদের উদ্যোগে সোমবারের মতবিনিময় সভা হয়।
সভায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান বলেন, “এরকম একটি ঘটনা আমাদের বানিয়াচংয়ে হওয়ায় আমরা সবাই লজ্জিত। দেশের একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক রাজীব নূর বানিয়াচংয়ে এসে আক্রান্ত হলেন, আরও কয়েকজন সাংবাদিক।
শিক্ষাবিদ স্বপন কুমার দাশ বলেন, “আমার এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি অনুসন্ধান করতে এসে এখানে হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিক রাজীব নূর। এই ঘটনাটি লজ্জার। যারা সম্মানীয়, তাদের যদি সম্মান না দিতে পারি, তবে আমরা কীভাবে বড় হব?”
হবিগঞ্জে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে সাংবাদিকদের উপর ‘দখলদারদের’ হামলা
রামনাথ বিশ্বাসের স্মৃতি রক্ষার দায়িত্ব সরকারের: শত নাগরিকের বিবৃতি
রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি উদ্ধারে সাইকেল শোভাযাত্রা যাবে বানিয়াচংয়ে
সভায় উপস্থিত রাজীব নূর সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় বলেন, “সেদিন ইট দিয়ে আমাদের সহকর্মী আলমগীরকে মাথায় মারতে চেয়েছিল। আমাদের আরেক সহকর্মী পেছন থেকে জাপটে না ধরলে হয়ত আমাদের সহকর্মী আলমগীরের সেখানে প্রাণ সংশয় হতে পারত। এটি স্পষ্টই হত্যাচেষ্টা।
“আমরা দ্রুত বিচার চাই। রামনাথের বাড়ি দখল করে থাকা ওয়াহেদ মিয়া আল বদর পরিবারের সদস্য। বিভিন্ন সময় রামনাথের বাড়ি দেখতে যাওয়া পর্যটকদের বাধা দিয়েছে, অপমান করেছে ওয়াহেদ মিয়ার পরিবার। রামমাথের বাড়ি দখলমুক্ত করে বাড়িটিকে পাঠাগার এবং সাইকেল মিউজিয়াম করে সংরক্ষণ করা হোক।”
সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সভায় বলেন, “আমরা বানিয়াচংবাসীর পক্ষ থেকে সাংবাদিক রাজীব নূরের কাছে ক্ষমা চাই। আমাদের গর্বিত সন্তান রামনাথ বিশ্বাসকে নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন রাজীব নূর।
“এই হামলার ঘটনায় আরেকটা ব্যাপার হয়েছে, আমরা অতীতে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখল করা নিয়ে কেউ জোরালোভাবে কথা বলতে পারিনি। এখন একটা জনমত তৈরি হয়েছে। আমাদের বানিয়াচংয়ের গর্বিত সন্তান রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলমুক্ত করা সহজ হবে।”
তিনি বলেন, “রামনাথের বসতভিটা উদ্ধারের জন্য দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিয়েছেন। এখন একটা আলোচনা যেহেতু হয়েছে, আমার মনে হয় বানিয়াচংবাসী এখন আর পিছাইবে না। আমরা আশা করবো, রামনাথের বাড়িতে পাঠাগার, সাইকেল মিউজিয়াম করার দিকে সরকার ও প্রশাসনও তৎপর হবেন।”
বর্তমান চেয়ারম্যান মিজানুর বলেন, “রামনাথ বিশ্বাস আমাদের বানিয়াচংয়ের গর্ব। তার বাড়ি দখলমুক্ত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই আন্দোনলনের সাথে সংহতি জানিয়ে আমরা রামনাথের বাড়ি দখলমুক্ত করার জন্য প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানাই। আমার দিক থেকে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।”
স্বপন দাশ বলেন, “এই বানিয়াচংয়ের সন্তান হেম সেন ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কর্মী। হেম সেনকে খুঁজতে ব্রিটিশরা বানিয়াচং এসেছিল। বীরের এলাকা বানিয়াচংয়ের আরেক কীর্তিমান রামনাথ বিশ্বাস। তার বাড়ি সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে বানিয়াচং এই ভূ-পর্যটককে নতুন করে আলোচিত হবে।”
সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু বলেন, “বানিয়াচংবাসীকে বলব, জেগে ঘুমাবেন না। মানুষ জেগে উঠলে শয়তান পালায়। আমাদেরকে জেগে উঠতে হবে। সাংবাদিক রাজীব নূরের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে এখন একটা প্রীতিকর কিছু হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বানিয়াচংবাসী সবাই রামনাথের বসতভিটা পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে একাত্ম আছি।”
যে কোনো ভালো কাজে বাধা আসে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা কোনো ব্যক্তিস্বার্থে এই আন্দোলনে নামিনি। আমরা আমাদের ইতিহাসকে সংরক্ষণের জন্য এই আন্দোলনে নেমেছি। সকল শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই আন্দোলনে একাত্ম হবেন।”
রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি আয়োজিত সাইকেল শোভাযাত্রা সফল করতে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন বক্তারা।
কমিটির আহ্বায়ক ভূ-পর্যটক আশরাফুজ্জামান উজ্জল, যুগ্ন আহ্বায়ক কবি শাহেদ কায়েস সভায় উপস্থিত ছিলেন।
উজ্জ্বল জানান, মঙ্গলবার সকাল ১১টায় হবিগঞ্জ টাউন হল থেকে রামনাথের বাড়ির পথে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা শুরু হবে। ওই দিনই সকাল ১১টায় বানিয়াচং শহীদ মিনারে সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু প্রতীকী অনশনে বসবেন।
বাইসাইকেল শোভাযাত্রাটি রামনাথের বাড়ি বিদ্যাভূষণ পাড়া ঘুরে এসে বানিয়াচং শহীদ মিনারে বিকাল ৪টায় সমাবেশ শেষে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
শাহেদ কায়েস বলেন, “এই আন্দোলনে বানিয়াচংবাসী যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছে, আমাদের বিশ্বাস আন্দোলন সফল হবে। একজন ওয়াহেদ মিয়া বানিয়াচংবাসীর চোখ খুলে দিয়েছেন রাজীব নূরের মতো খ্যাতিমান সাংবাদিককে অপমান করে। এবার সম্মিলিত প্রতিবাদে নিশ্চয় উদ্ধার হবে রামনাথের বসতভিটা। আমরা রামনাথকে ফিরিয়ে দিতে পারব তার বাইন্ন্যাচং।”
সাইক্লিস্টরা জড়ো হচ্ছেন হবিগঞ্জে
রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার আন্দোলন বেগবান করার কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হবিগঞ্জে আসছেন সাইক্লিস্টরা।
সোমবার সন্ধ্যায় কুমিল্লা থেকে সাইক্লিস্টদের একটা দল এসে হবিগঞ্জে পৌঁছায়, তারা ক্যাম্প করেছে বৃন্দাবন কলেজ প্রাঙ্গণে। রাতে সেখানেই অবস্থান করে, সকালে শোভাযাত্রায় যোগ দেবে দলটি।
এই দলের মাহমুদুল ইসলাম ইফাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার করে সেখানে পাঠাগার ও সাইকেল মিউজিয়াম করার দাবির সাথে একাত্ম হতেই কুমিল্লা থেকে সাইকেল নিয়ে হাজির হয়েছি আমরা।”
নবীগঞ্জ উপজেলা থেকে সকালে এসে যুক্ত হচ্ছে লাল সবুজ সাইক্লিং ক্লাব। এই ক্লাবের ২৫ জনেরও বেশি সাইক্লিস্ট থাকবে শোভাযাত্রায়।
লাল সবুজ সাইক্লিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাজহারুল ইসলাম তারেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রামনাথ বিশ্বাস পৃথিবীর সেরা ১০ জন ভূ-পর্যটকের একজন। ৩০টিরও বেশি ভ্রমণ বিষয়ক বই লিখেছেন তিনি। তার মতো গুণী ব্যক্তিত্বের জন্ম আমাদের হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে। তার বসতভিটা দখল হয়ে আছে। তাই আমরা সাইকেল র্যালির মাধ্যমে দাবি জানাব রামনাথের বসতভিটায় সাইকেল মিউজিয়াম এবং পাঠাগার যেন করা হয়। পাশাপাশি হবিগঞ্জের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রামনাথের ছবি রাখা হয়। প্রতি বছর পর্যটন দিবসে যেন রামনাথকে নিয়ে সরকারিভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, ঢাকাসহ নানা জায়গা থেকে সাইকেল শোভাযাত্রায় যোগ দিতে হবিগঞ্জে আসছেন সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ নানাজন।
শোভাযাত্রায় যোগ দিতে দেশের অন্যপ্রান্ত দিনাজপুর থেকে হবিগঞ্জ রওনা হয়েছেন দিনাজপুরের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ভাবনা’র প্রধান নির্বাহী মুস্তাফিজুর রহমান রূপম। তিনি জানান, কুরিয়ারে তার সাইকেলটি পাঠিয়েছেন এবং তিনি বিমানে ঢাকায় এসে ট্রেনে হবিগঞ্জ আসবেন। সকালে সাইকেল নিয়ে যোগ দেবেন শোভাযাত্রায়।