বাজার সামলাতে যা দরকার তা করা হচ্ছে না: গোলাম রহমান

সাধারণের উপর দাম বাড়ার প্রভাব মূল্যস্ফীতির হিসাবের চেয়েও বেশি হওয়ায় কষ্টে আছে মানুষ, বলেন ক্যাব সভাপতি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 03:52 PM
Updated : 21 May 2023, 03:52 PM

ঊর্ধ্বমুখী পণ্যমূল্যের বাজারে এখনকার সবচেয়ে বড় সমস্যা ‘ন্যায্য প্রতিযোগিতার অভাব’ মন্তব্য করে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, এ কারণেই ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হচ্ছে না, প্রতিযোগিতা কমিশনও প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পণ্যের দামে লাগাম টানতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেগুলো ঠিকমত নেওয়া হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সাবেক এই সচিব।

রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’ এ অতিথি হয়ে এসে তিনি উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থা ও পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা, ব্যবসায় প্রতিযোগিতা, আইনি ব্যবস্থা ও জনগণের উপর এসবের প্রভাব, ব্যবসায় নৈতিকতা নিয়েও আলোচনা করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক এই চেয়ারম্যান আরেক প্রশ্নে বলেন, “বাংলাদেশে অনেক অভিযোগ, অনেক ব্যবস্থা আছে কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই কম। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও তাই।”

মূল্যস্ফীতির বর্তমান চাপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেয়, সাধারণ মানুষের উপর দাম বাড়ার প্রভাব এর চেয়েও বেশি পড়ার কথা বলেছেন তিনি।

মূল্যস্ফীতির চেয়েও বেশি প্রভাবের কারণ ব্যাখ্যায় গোলাম রহমান বলেন, “বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাবের ঝুড়িতে বেশ বড় সংখ্যার পণ্য রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্ন মধ্য আয়ের মানুষ, ভোগ করে ২০ থেকে ২৫টি পণ্য।

“প্রায় ২০০টি পণ্যের তুলনায় এসব পণ্যের দামই গড়ে বেশি বাড়ে। সুতরাং বিবিএস যে হিসাব দেয়, সাধারণ মানুষের উপর দাম বাড়ার প্রকৃত প্রভাব এর চেয়ে অনেক বেশি।”

এ প্রভাবের বিষয়ে আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, “সাধারণ ধারণা হচ্ছে মূল্য বাড়ার প্রভাব অনেক বেশি এই হিসাবের চেয়ে, এটা কমপক্ষে দুই অংকের… যেটা পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব করে সেটির চেয়ে।”

মূল্যস্ফীতির অনেক বিষয় সরকারের ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’

সরকার কি ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করছে কি না- এমন প্রশ্নে গোলাম রহমান বলেন, “সরকারের বিভিন্ন বিষয় চলে লবিং ক্ষমতার ভিত্তিতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সময়ে ব্যবসায়ীদের লবিং ক্ষমতা ভোক্তা বা অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি।”

শুধু নিয়ম-নীতির উপর দাম নির্ভর করে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অনেক উপায় রয়েছে।

“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল আর্থিক নীতি ও মুদ্রানীতি। বাণিজ্য নীতি একটা ভূমিকা রাখে ঠিক কিন্তু এটা মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করার প্রধান নির্ধারক নীতি নয়।”

তিনি বলছেন, মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে অনেক বিষয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে যা রয়েছে, তাও ঠিকমত কাজ করছে না।

ধনীদের চাহিদার কারণে দরিদ্ররা ভুগছে

মূল্যস্ফীতির পেছনে আন্তর্জাতিক কারণ থাকার বিষয়ও তুলে ধরে ক্যাব এর সভাপতি বলেন, “তবে বিদেশে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলার জন্য সরকারকে কিছু আর্থিক ও মুদ্রা বিষয়ক পদক্ষেপ নিতে হয়।

“সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে, যা আমরা এখানে করছি না। অন্যদিকে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছি, অর্থ মন্ত্রণালয় বড় অংকের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছে। আমি পত্রিকায় দেখেছি, এটা প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মূলত কাগুজে মুদ্রা ধার করা হচ্ছে। এবং এটার বহুগুণ প্রভাব রয়েছে। অর্থনীতিতে যদি বিপুল সংখ্যক টাকা অল্প পণ্যের দিকে দৌড়ায়, তাহলে দাম বাড়তেই থাকে।”

মূল্যস্ফীতি বজায় থাকার পেছনে গত এক বছরে ডলারের টাকার মান ২৫-৩০% কমে যাওয়ার কথা তুলে ধরে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে এখন দাম কমে আসছে অনেক পণ্যের। কিন্তু টাকার বিপরীতে ডলারের দাম অনেক বেশি হওয়ার কারণে এক বছর বা তার আগের তুলনায় এখানে দাম অনেক বেশি।”

টাকার দাম কমে যাওয়ার পাশাপাশি টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কিছু মানুষ বেশি দামে পণ্য কিনতে সক্ষম। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। ধনীদের চাহিদার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ভুগছে।”

নিশ্চিত করতে হবে ‘প্রতিযোগিতা’

ব্যবসায়ীদের ‘অনৈতিক চর্চা’ মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশন সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না উল্লেখ করে গোলাম রহমান বলেন, “আমরা যেভাবে প্রত্যাশা করেছিলাম, সেভাবে কাজ করছে না।”

তিনি বলেন, “ভোক্তা বা ক্রেতাদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার একমাত্র পথ হচ্ছে বাজারে প্রতিযোগিতা ও পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা। যদি টাকার দাম কমে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে এখানেও বাড়বে, এতে সন্দেহ নাই।

“এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতার অভাব।”

দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশনের যোগসাজশের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “তাদেরকে আরও সক্রিয় হওয়া উচিত, এটুকু আমি বলতে পারি। তারা যথেষ্ট করছে না, তারা যথেষ্ট করছে না।”

প্রক্রিয়া ‘জটিল ও দীর্ঘ’ হওয়ার কারণে আইনের বাস্তবায়ন সেভাবে না হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তবে এখনও কিছু অপরাধীকেও যদি আইনের আওতায় আনা যায়, আরও ভালো কিছু হবে।”

টিসিবির সক্ষমতা কতটুকু?

সরকারি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কম মূল্যের সরবরাহ পণ্যের দাম ঠিক রাখতে কতটুকু ভূমিকা রাখে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা যথেষ্ট নয়। তবে তারা যেসব পণ্য বিক্রি করছে সেগুলোর বেশিরভাগ ক্রয় করছে স্থানীয় বাজার থেকে। সুতরাং এখানে মোট সরবরাহ বৃদ্ধিতে কোনো ভূমিকা নেই। তারা দরিদ্র পরিবারের কাছে ৪-৫টা পণ্য বিক্রি করছে।

“সরকার দরিদ্র পরিবারের কাছে ভর্তুকি মূল্যে এগুলো বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারাদেশে টিসিবির ডিলার নেটওয়ার্ক রয়েছে। সুতরাং এটা এক ধরনের রেশনিং সিস্টেম। এটা কিছু মানুষের জন্য উপকারী। কিন্তু এটা দামের লাগাম টানার জন্য যথেষ্ট নয়। মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে এবং বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।”

নিজেরা পণ্য আমদানি করে সরবরাহ ঠিক রাখার সক্ষমতা টিসিবির আছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “একটা সময়ে তাদের এই সক্ষমতা ছিল। আমি মনে করি, বড় পরিমাণে আমদানি ও সেগুলো বিতরণ সক্ষমতা তাদের রয়েছে, সারাদেশের বিতরণ কেন্দ্রের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

“একটা সময় আমদানি ও সংরক্ষণের সক্ষমতা তাদের ছিল, সারাদেশে অনেক ওয়্যারহাউজ রয়েছে। তবে আমি নিশ্চিত নই, তারা সেই গুদামগুলো বজায় রেখেছে কি না। কারণ, তারা কেবল আগুন নেভানোর কাজ করছে, সরকারের দ্বারা নিয়মিত মূল্য ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখছে না।”

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করলে রেশনিং ‘সঠিক পন্থা নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সঠিক পন্থা হচ্ছে প্রতিযোগিতা ও পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ বজায় রাখা। আপনি যদি সেটা করতে পারেন, তাহলে ভোক্তারা ন্যায্য মূল্য পাবে।”

কৃষিপণ্যে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা অনেক

কৃষকের লাভের অংশ মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পকেটে যাওয়ার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে গোলাম রহমান বলেন, “পচনের সুযোগ থাকার কারণে কৃষিপণ্যে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে অনেক সময় বাধাহীন সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় না।

“এ কারণে ব্যবসায়ীরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝুঁকিমুক্ত থাকতে চায়। এ কারণে তারা অনেক সময় একেকজন একেকজনের কারণে ট্রাকের উপরেই পণ্য বিক্রি করে দেয়।”

পরিবহনে ফ্রিজার ভ্যান ও হিমাগারের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষকদের সমবায় সমিতির মাধ্যমে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করা যেতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কৃষকদের সমবায় সমিতি যদি কনজাম্পশন পয়েন্টে সরাসরি পণ্য বিক্রির সুযোগ পায়, তাহলে মধ্যস্বত্ত্বভোগী সেখানে থাকবে না।”

সরকারকে নিতে হবে আরও বড় ভূমিকা

মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে রেশনিং ব্যবস্থা যায় না উল্লেখ করে বাংলাদেশ মিশ্র অর্থনীতির দিকে যেতে পারে বলে মনে করছেন ক্যাব সভাপতি।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কী ঘটছে? মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বেশিরভাগ পণ্যের বিকিকিনিতে গুটিকয়েক প্রভাব বিস্তার করছে। এটা একচেটিয়া পদ্ধতি। যদি কর্তৃপক্ষ দ্বারা একচেটিয়া ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে তারা বাজার শাসন করবে এবং দাম ঠিক করে দেবে।

“আমি মনে করি, সময় এসেছে মুক্তবাজার দর্শনের পরিবর্তে আমাদেরকে মিশ্র অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে চিন্তা করা উচিত। সরকারকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, আমদানি ও উৎপাদনে আরও বড় ভূমিকা পালন করা উচিত।”

চর্চা ‘নৈতিক’ হলে কন্টাক্ট ফার্মিং ‘বেশ ভালো’

কীভাবে পরিচালিত হবে- সেটির উপর ‘কন্ট্যাক্ট ফার্মিং’ এর সাফল্য নির্ভর করে উল্লেখ করে এক প্রশ্নে গোলাম রহমান বলেন, “চর্চা যদি নৈতিক ও সুষ্ঠু হয় তাহলে কন্টাক্ট ফার্মিং বেশ ভালো। ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির ক্ষেত্রে তারা এটাকে ভুল পণ্যের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় করেছে। তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং তারা খুবই সফল হয়েছে। তারা খুব সফলতার সঙ্গে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি মান নিশ্চিত করতে পেরেছে।

“কিন্তু পোল্ট্রির ক্ষেত্রে বড় হ্যাচারিগুলো এটাকে ব্যবহার করছে, সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সুতরাং এটাকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

এটার পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “যদি রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক যথেষ্ট ভালো হয় এবং সেটার বাস্তবায়ন যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা আরও সুদিন দেখব।”

ভেজাল বন্ধে আইন যথেষ্ঠ? 

খাদ্যে ভেজাল বন্ধে আইন ও এর বাস্তবায়ন যথেষ্ঠ কি না- এমন প্রশ্নে গোলাম রহমান বলেন, “আমি মনে করি না এগুলো যথেষ্ট। খাদ্যে ভেজাল যদি জীবনের জন্য হুমকি হয়, তাহলে সর্বোচ্চ মাত্রার শাস্তি দিতে হবে।”

ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দিতে পারার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটা কিছুই না। জরিমানা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি অপরাধীদেরকে জেলে পাঠাতে হবে। কিন্তু আমাদের আইনি ব্যবস্থা খুবই সময়সাপেক্ষ। এটা সুশাসন বাধাগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম কারণ।”