বাতিল নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন হবে: আনিসুল হক

আনিসুল হক বলছেন, সাংবাদিকের স্বাধীনতা ‘হরণে’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি হয়নি। শুরুতে এ আইনের ‘কিছু অপব্যবহার হলেও’ বর্তামানে তা কমেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2023, 10:47 AM
Updated : 3 May 2023, 10:47 AM

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে বাতিল হবে না, সে কথা আবারও জানালেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। 

তিনি বলেছেন, "আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে না, তবে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তেমন কিছু সংশোধন আনা হবে।" 

সাংবাদিকের স্বাধীনতা ‘হরণে’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি হয়নি দাবি করে আনিসুল হক বলছেন, শুরুতে এ আইনের কিছু অপব্যবহার হলেও বর্তামানে তা কমেছে। আর সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ‘পক্ষেই আছে’। 

‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ উপলক্ষে বুধবার ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) আয়োজনে এক আলোচনা সভায় এ আইন নিয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেন আনিসুল হক। 

তিনি বলেন, “প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে যখন দেশে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রচার বেড়েছে তখন সাইবার অপরাধ রোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও আইনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সাইবার অপরাধ রোধেই তখন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করা হয়েছে। “ 

এ আইন করার আগে ‘সব পক্ষের সাথে’ আলোচনা হয়েছে দাবি করে মন্ত্রী বলেন, “এই আইন যখন নতুন নতুন হয়েছে, তখন এর কিছু অপব্যবহার হয়েছে, তা আমি স্বীকার করি, সরকারও করে। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপের কারণে তা কমে এসেছে।” 

দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও উদ্বেগের মধ্যে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ব্যাপক সমালোচিত ৫৭সহ কয়েকটি ধারা বাতিল করে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হলেও পুরনো আইনের বাতিল হওয়া ধারাগুলো নতুন আইনে রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগের শঙ্কা ছিল উদ্বেগের কেন্দ্রে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালে কারাগারে মারা যাওয়ার পর ওই আইন বাতিলের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল।

এরপর আইনের ‘অপব্যবহার’ বন্ধে আইনমন্ত্রীর আশ্বাসের মধ্যেও সংবাদকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার থেমে থাকেনি।

সর্বশেষ মার্চের শেষে এক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে প্রথম আলোর একজন সাংবাদিককে ভোররাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনায় ওই আইন বিলোপের দাবি নতুন করে আলোচনায় আসে।

প্যারিসভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যে কোনো সমালোচনার জন্য ‘গণমাধ্যমের উপর খড়গ চালানো’ বাংলাদেশের সরকারকে বন্ধ করতে হবে।

আর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফোলকার টুর্ক বলেন, “এ আইনের ব্যবহার অবিলম্বে স্থগিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের শর্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংস্কারের জন্য আমি আবারও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

মুদ্রিত পত্রিকার সম্পাদকদের একটি সংগঠন সম্পাদক পরিষদ গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানায়। সেখানে বলা হয়, যদি আইন বাতিলে সরকারের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, তাহলে এমন একটি ধারা যুক্ত করতে হবে, যেখানে বলা থাকবে, এই আইন গণমাধ্যম, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রযোজ্য নয়।

বুধবার টিআইবির অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সরকার এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আরও ‘স্বচ্ছ’ করার উদ্যোগ নিয়েছে। 

“জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের পক্ষ থেকে আমাদের একটা টেকনিক্যাল (কারিগরি) নোট পাঠানো হয়েছে। আমরা সেটা নিয়ে কাজ করছি, তাদের কিছু ধারা বাদ দেওয়া এবং সংশোধনের বিষয়ে পরামর্শ ছিল। 

“যদিও আমাদের মতভেদ রয়েছে। আমরা বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই, অক্টোবরের পরে নয়, আমরা সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংশোধনীটা করব।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের অযথা গ্রেপ্তার না করার নির্দেশনা আছে জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, “এখন মামলা হলেই তা গ্রহণ করা হয় না। এটা একটি বিশেষ সেলে পাঠানো হয়, এরপর যাচাই-বাছাই শেষে আদালতে মামলা দাখিল করা হয়। সেলকে বলা হয়েছে অযথা সাংবাদিকদের যেন গ্রেপ্তার করা না হয়।” 

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের নিম্নগামী অবস্থানের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর কাছে তার বক্তব্য জানতে চান সাংবাদিকরা। 

মন্ত্রী বলেন, “গণমাধ্যমের স্বাধীনতার লিস্টে বাংলাদেশ যদি আফগানিস্তানের নিচে থাকে, তবে সেটা আসলেই প্রশ্নের সৃষ্টি করে।” 

গণমাধ্যমের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ‘উদারতা’ এবং তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের কথা তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, “সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে আছে।“ 

এর আগে আলোচনা পর্বে ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, “বেশি গণমাধ্যম থাকলেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না, সেটা আমরা দেখছি। সবচেয়ে জরুরি মুক্তভাবে কাজ করতে পারা।” 

অনুষ্ঠানে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে তার দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের উদাহরণ টানেন। 

তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যাপার নয়, এর জন্য একটি বাস্ততন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার হাতে হাত রেখে চলে। একটা গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এই দুটি বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

“যখন গণমাধ্যম স্বাধীন হয়, তখন সে তার সরকারকে প্রশ্ন করতে পারে, সমাজে কোনো বৈষম্য থাকলে সেটিকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। গণমাধ্যম স্বাধীন হলেই কেবল সমাজকে পরিবর্তন সম্ভব।” 

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ করতে হয় না, এর প্রয়োগ করেই অনেকক্ষেত্রে মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে।” 

বিভিন্ন উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “এসব ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নানাভাবে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বিষয়কে লঙ্ঘন করে আসছে।” 

‘শেপিং আ ফিউচার অব রাইটস’ শীর্ষক ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের অফিসার-ইন-চার্জ সুজান ভাইজ এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গুইন লুইসও বক্তব্য দেন। 

তারা জাতিসংঘের আর্টিকেল-১৯ এ গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতির প্রসঙ্গ তুলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে এসডিজি লক্ষ্য বাস্তবায়নের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে আরও কাজ করার আহ্বান জানান। 

গুইন লুইস বলেন, “স্বাধীন গণমাধ্যম দারিদ্র দূরীকরণ থেকে শুরু করে,  সকল উন্নয়নের যাত্রায় সরকারকে জনগণের জবাবদিহিতায় উৎসাহিত করে।” 

আর বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে অন্য সবকিছুর স্বাধীনতা আসবে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। 

অনুষ্ঠান শেষে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এটা (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) বাতিল না হলে সেটা বাক স্বাধীনতার জন্য ভালো কিছু হবে না।“