আসামিদের বিরুদ্ধে বন্ধকী সম্পত্তির তথ্য গোপন ও কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
Published : 06 Feb 2025, 09:53 PM
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সময় আর্থিক অনিয়মের জন্য আলোচিত ন্যাশনাল ব্যাংকের ‘ঋণ জালিয়াতির’ চারটি ঘটনায় ৯১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চারটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
এসব মামলায় আসামির তালিকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও সিকদার গ্রুপের সদস্য মনোয়ারা সিকদার, পারভীন হক সিকদার, রণ হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের নাম রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলা চারটি করা হয়েছে বলে সংস্থার মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এসব মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ৯১০ কোটি টাকা সুদসহ বর্তমানে ১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
আওয়ামী লীগে সরকারের পতনের পর ২৯ ডিসেম্বর কাগুজে বিল সৃষ্টি করে ঋণের ৪৫৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে এই মামলায়। সে মামলায় আসামির তালিকায়ও ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ওই চার পরিচালকের নাম রয়েছে।
রণ হক ও রিক হকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুদকের করা মামলাগুলোর মধ্যে ৪৯০ কোটি টাকা ‘আত্মসাতের’ অভিযোগে করা মামলায় অন্য আসামিরা হলেন- ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শরীফ উজ্জামান খান, চেয়ারম্যান জনাব মো. ইসমাইল, পরিচালক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, পরিচালক তওসিফ সাইফুল্লাহ্; দেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হাসান টেলিকম চেয়ারম্যান ও ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের শেয়ারহোল্ডার আরিফ হাসান।
আসামিদের তালিকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালকদের মধ্যে আছেন খলিলুর রহমান ও মাবরুর হোসেন, বর্তমান পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ (সি এম আহমেদ), সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ রইস উদ্দিন, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ও কোম্পানি সেক্রেটারি এ এস এম বুলবুল, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ ওয়াদুদ ও সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রজব আলী।
এ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দেশ টেলিভিশনের কিছু কর্মচারীর নাম ব্যবহার করে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে সিকদার পরিবার ও দেশ টেলিভিশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসান পরস্পর যোগসাজশে ঋণ নিয়েছিলেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তারা ১৬ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখা থেকে ৪৯০ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন।
নিজস্ব সম্পত্তি না থাকলেও একই ব্যাংক শাখা থেকে হাসান টেলিকমের নামে নেওয়া ঋণের বন্ধকী সম্পত্তির তথ্য গোপন করে তা বন্ধকের প্রস্তাব করেন। এর ভিত্তিতে ব্যাংকের নির্বাহী ও কিছু অসৎ কর্মকর্তার সহযোগিতায় এ ঋণ অনুমোদন ও ছাড় করা হয়।
৪৫৯ কোটি টাকা 'আত্মসাৎ', সিকদার পরিবারের সদস্যসহ আসামি ২৯
গত বছর ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অনাদায়ী সুদ ও অন্যান্য চার্জ বাবদ ১৭৮ কোটি ৮৯ লাখ ১১ হাজার ৪০০ টাকা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির অভিযোগে ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
৩০০ কোটি টাকা আরেক মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৩ জনকে। তারা মধ্যে আছেন- মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলম আহমেদ, পরিচালক বাবু হরিদাস বর্মণ, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক আরিফ মো. শহীদুল হক, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল, এম এ ওয়াদুদ, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ।
এছাড়া ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক রণ হক সিকদার ও রিক হক সিকদার, পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক এ কে এম এনামুল হক শামীম, সাবেক পরিচালক খলিলুর রহমান, সাবেক পরিচালক জাকারিয়া তাহের ও সাবেক পরিচালক মাবরুর হোসেনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে মরিয়ম কনস্ট্রাকশন ‘অবৈধভাব’ ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা সুদ-আসলে ৫৮৩ কোটি ১৩ লাখ ৩ হাজার ৮৪৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখা থেকে ৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে করা অন্য মামলায় আসামিদের মধ্যে আছেন- প্রকৃতি অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী মো. শরীফ-উজ্জামান খান, দেশ টেলিভিশনের আরিফ হাসান, ব্যাংকটি তৎকালীন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈয়দ রইস উদ্দিন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ ওয়াদুদ, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল, সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ঋণ প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (বর্তমানে ইভিপি) মো. জহিরুল ইসলাম, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ক্রেডিট কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু রাশেদ নোয়াব, সাবেক পরিচালক খলিলুর রহমান ও মারুর হোসেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ঋণ নেওয়া প্রকৃতি অ্যাসোসিয়েটস একটি ‘কাগুজে’ প্রতিষ্ঠান। ‘ভুয়া’ কাগজপত্রের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া হয়েছে। সেই ঋণ বর্তমানে ১০১ কোটি ২৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের কুয়াকাটা শাখা থেকে ৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ করা মামলায় ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দি ভিউ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেডের নামে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে এই ঋণ নেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানে সুদাসলে ৬১ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার ২৭৯ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এ মামলার আসামিরা হরেণ হোটেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাহিদ সারওয়ার, পরিচালক মোস্তফা মঈন সারওয়ার, ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ, প্রিন্সিপাল অফিসার ও কুয়াকাটা শাখা ব্যবস্থাপক (চাকুরিচ্যুত) রুমি ইমরোজ রশিদ, ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারী।
এছাড়া ব্যাংকের সাবেক পরিচালকদের মধ্যে মনোয়ারা সিকদার, খলিলুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, রিক হক সিকদার, মাবরুর হোসেন ও সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক নাঈমুজ্জামান ভূইয়াকে আসামি করা হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০০৯ সাল থেকে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) পরিচালনা পর্ষদে নিয়ন্ত্রণ ছিল সিকদার পরিবারের।
দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার ২০২১ সালে মারা যান।
তার পর সিকদার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিবাদের জেরে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে। তার সময়ে ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক, ইউসিবির সঙ্গে এনবিএলকে একীভূত করার আলোচানা শুরু হয়।
অগাস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয় তখন এটির পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী এস আলমের। পরে এ ব্যাংকের পুরনো উদ্যোক্তা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসেন।