অক্সিজেন দেওয়ার সুবিধা আছে এমন শয্যার সংখ্যা হাসপাতালগুলোতে কম। সন্তানের জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় হাজারো অভিভাবক।
Published : 21 Oct 2024, 01:35 AM
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এক বছরের শিশু তাওসিন আহমেদকে কুমিল্লার বরুড়া থেকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য এনেও কোনো হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে ফেরাতে হল নিজের এলাকায়।
তাওসিনকে ঢাকায় এনে প্রথমে নেওয়া হয় আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে দেখে নিউমোনিয়া শনাক্ত করে ভর্তির পরামর্শ দেন।
তবে ওই হাসপাতালে অক্সিজেন সাপোর্ট আছে এমন শয্যা না থাকায় তার ব্যবস্থাপত্রে ‘দুঃখিত, এই মুহূর্তে কোনো ফ্রি/পেইং বিছানা খালি নেই’ সিল মেরে দেওয়া হয়।
এরপর শিশুটিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল বা যে কোনো সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হয়।
তাওসিনের বাবা আবদুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডাক্তার বলেছে তার অবস্থা না কি ভালো না। এইখানে ভর্তি হতে বলেছে। কিন্তু এইখানে (শিশু হাসপাতাল) সিট নাই।
“পরে আরও দুইটা হাসপাতালে গেছি, তারাও বলে সিট খালি নাই। ঢাকায় বেসরকারি হাসপাতালে রাইখ্যা চিকিৎসা করানো আমাদের পক্ষে কঠিন। এই জন্য আবার কুমিল্লায় নিয়া আসছি। এখানেই চিকিৎসা করতেছি।”
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, নিউমোনিয়ায় দেশে বছরে ২৪ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়, এই হিসাবে দিনে সংখ্যাটি ৬৫ এর বেশি।
২০২২ সালের জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী ৫ বছরের কম বয়সে মারা যাওয়া প্রতি ১০০টি শিশুর মধ্যে ২৪ জনের মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া।
এমন শিশুর অবস্থা জটিল হয়ে গেলে অক্সিজেন সহায়তা দরকার হয়। কিন্তু জেলা হাসপাতালগুলোতে এই ধরনের শয্যার সংখ্যা সীমিত। ফলে রোগীকে ঢাকা বা বড় শহরে পাঠাতে হয়। কিন্তু এখানেও রোগীর চাপে শয্যা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
শুধু নিউমোনিয়া না, শিশুদের আরও অনেক রোগের চিকিৎসায় অক্সিজেন সাপোর্ট লাগে। কিন্তু উপজেলা, জেলা বা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতেও এই ধরনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
ফলে তাওসিনের মত অসংখ্য শিশুকে নিয়ে এভাবে প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরছেন অভিভাবকরা। কেঁদে চলে শিশুরা, কখনো তাদের কান্না থেমে যায় চিরকালের মত।
কেননা সরকারি হাসপাতালে শয্যা না পেলে যে আর্থিক হিসাব সামনে আসে সেটি সামাল দেওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু জাফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী হাসপাতালে যে শয্যাসংখ্যা থাকার কথা ছিল তা কোথাও নেই। একই অবস্থা শিশুদের ক্ষেত্রেও।
“৫০০ বেডের হাসপাতালে রোগী দেড় হাজার। রোগী অনুযায়ী যে বেড থাকার কথা তা নাই। এগুলো আমাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা। সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। শিশু হাসপাতাল আরও বাড়াতে হবে।”
শয্যা না দিতে পেরে গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১২০০ শিশুকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট। প্রকৃত সংখ্যা কিছু বেশি, রোগীর চাপ বেশি থাকলে অনেক সময় সবার নাম নথিভুক্ত করা যায় না। এসব শিশুদের অন্তত ৯০ শতাংশেরই অক্সিজেন প্রয়োজন ছিল।
৬৮০ শয্যার এই হাসপাতালে ১৮টি এনআইসিইউ, ১৮টি পিআইসিইউ, ১৮টি এইচডি ও আইসোলেশন শয্যা এবং ৩৬১টি অক্সিজেন সুবিধাসম্পন্ন শয্যা আছে, কিন্তু তা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট না।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মাহমুদুল হক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে একটা বেডে একজন শিশুকে ভর্তি করা যায়। তাই যতক্ষণ সিট থাকে ততক্ষণ আমরা ভর্তি নেই। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি শিশু আমাদের হাসপাতালে আসে, তাদের অন্য সরকারি হাসপাতালে রেফার করি।”
একটু অক্সিজেনের খোঁজে
গত ১ অক্টোবর ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর থেকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত এক বছর বয়সী শিশু ওমরকে আনা হয় সেই শিশু হাসপাতালে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে ভর্তি করা হয় বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
শিশু হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে শিশুটিকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সে সময় তার অবস্থা খুব খারাপ। তীব্র শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি অপুষ্টিতে ভোগা ওমরকে জরুরি বিভাগে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়।
কিন্তু এই হাসপাতালেও শয্যা খালি ছিল না। এরপর ঢাকার আরও কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেও হতাশ হতে হয় পরিবারটিকে।
পরে শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওমরকে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মত সংগতি নেই পরিবারটির। তার নানা হাসমত উল্লাহ বলছিলেন সে কথাই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাত হাজার টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিয়া আসছি। পুরা টাকা দিতে পারি নাই। এখন ওই হাসপাতালের বিল ক্যামনে দিমু মাথায় ধরতেছে না।”
১০ অক্টোবর সিটি জেনারেল হাসপাতালে গেলে সেখানকার অভ্যর্থনা থেকে জানানো হয়, ওই হাসপাতালে দুদিন চিকিৎসা দেওয়া হয় ওমরকে। কিছুটা সুস্থ হলে তাকে বাড়ি নিয়ে যান অভিভাবকরা।
হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘোরাই ‘নিয়তি’
শিশু হাসপাতাল থেকে রেফার করা শিশুদের বেশিরভাগই যায় লাগোয়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে। সেখানে কিছু শিশু ভর্তি নিতে পারলেও বেশিরভাগকেই ব্যর্থ হতে হয়।
হাসপাতালের ৩১৪ এবং ৩১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সারা বছরই থাকে রোগীর ভিড়। প্রতিটি শয্যায় একাধিক শিশু, সঙ্গে থাকতে হয় অভিভাবকদের। ভিড়ের চাপে নড়াচড়াই দায়।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের চার বছর এক মাস বয়সী জান্নাতুল ফেরদৌসিকে নিয়ে মা মা হাসনা হেনা শিশু হাসপাতাল ঘুরে যান সোহরাওয়ার্দীতে। শয্যা পেয়েছেন, কিন্তু যে চিত্র, তা দেখে চিকিৎসা করানো নিয়েই উদ্বেগে তিনি।
“ডাক্তার বলছে জরুরিভিত্তিতে তারে ভর্তি করতে হবে, জ্বরের কারণে প্রস্রাবে ইনফেকশন হয়ে গেছে, আবার নিউমোনিয়াও আছে। তারা ভর্তি না করাইয়া এইখানে নিয়া আসতে বলেছে। ভর্তি তো হইছি, কিন্তু নড়াচড়ার সুযোগ নেই।”
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাবো এলাকার শিশু সাজিদ হোসেনকে নিয়ে আসা মা শাহনাজ বেগম বলেন, “শিশু হাসপাতাল দুইদিন ঘুরছি, ভর্তি করতে পারি নাই। পোলার অবস্থা সিরিয়াস হইয়া গেছিল। পড়ে এইখানে নিয়া আসছি। এক বেডে দুইজন দেয়, যাই নাই, ভর্তি করছি। এখন দেখি তিনজন কইরা দিছে।”
মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে দুই বছর বয়সী এক শিশুকে নিয়ে এই সরকারি হাসপাতালে আসেন তার বাবা। তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা শিশুটিকে অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন দেওয়া অবস্থায় রেখেই তার বাবা ৩১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ছুটে আসেন। সেই বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে আইসিইউতে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
শিশুটির বাবা বলেন, “চার লিটার অক্সিজেন দিয়ে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে রেখে এসেছি। জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি করা দরকার। শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম, ভর্তি করাতে পারিনি।”
সোহরাওয়ারার্দী হাসপাতালে এসে এই বাবার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরও বাড়ল। সেখানে আইসিইউ, পিআইসিইউ নাই। এ কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে ৩১৩ নম্বর ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক বলেন, তাদের ইউনিটে ২০টি শয্যা, কিন্তু ৬০ থেকে ৭০ বাচ্চা সব সময় ভর্তি থাকে।
“নিউমোনিয়াসহ শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা বাচ্চা যাদের নরমাল অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া যাবে, একটা বেডে এমন তিনজন করে বাচ্চা ভর্তি নিই। এরপর কেউ আসলে রেফার করে দিই। আর আইসিইউ, ভেন্টিলেশন লাগবে এমন শিশু ভর্তি করাতে পারি না।”
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সুবিধা নাই। সিলিন্ডার মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে শয্যা না পাওয়া শিশুদেরকে নিয়ে অভিভাবকদের গন্তব্য সাধারণত থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানে ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলে শিশুদের।
সেখানেও ওয়ার্ডে একটি শয্যায় নাকে নল লাগানো দুটি শিশুকে শুইয়ে রাখতে দেখা গেল। পাশেই আরেকটি শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তার মা। তারও নাকে নল দেওয়া। ওই তিনটি শিশুকে একটি বেডে ভর্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের মায়েরা আছেন পাশে।
ওই ওয়ার্ডের প্রতিটি শয্যায় তিনটি করে শিশু ভর্তি। কয়েকটি শিশুকে মেঝেতে বিছানা পেতে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগই নিউমোনিয়া বা অন্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগছে।
শিশু বিভাগের ইউনিট-১ এ দুটি ভাগ। একটি ওয়ার্ডে ২৩টি শয্যায় ৬০ জন এবং আরেকটি ওয়ার্ডে ১৪টি শয্যার বিপরীতে ৫৭টি শিশু।
ইউনিট-২ এর ১৯টি শয্যার বিপরীতে ৭০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত শিশু ভর্তি রাখতে হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
নারায়ণগঞ্জের মদনপুর থেকে এক বছর বয়সী জেনিফা নূরকে শিশু হাসপাতাল ঘুরিয়ে ঢাকা মেডিকেলে এনে ভর্তি করতে পারলেও তীব্রভাবে হতাশ মা আমেনা বেগম।
তিনি বলেন, “নিউমোনিয়া হইছে, অক্সিজেন লাগতেছে তাই ভর্তি করাইছি। এক বেডে তিনটা করে বাচ্চা। অনেক কষ্ট, সারা রাইত দাঁড়াইয়া, বইস্যা কাটাইছি। বাচ্চারে বাঁচাইতে হইলে এই কষ্ট করতেই হবে।”
শিশু বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক লুৎফন নেছা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে এলে আমরা সাধারণত ফেরাই না। কিন্তু এক বেডে তিনটা পেশেন্ট থাকে, নিচে দুইটা থাকে। একটা বেডের বিপরীতে পাঁচটা করে বাচ্চা ভর্তি দিতে হয়।
“মাঝেমধ্যে এমন সমস্যা হয় আমরা পেশেন্টকে যে সার্ভিস দেব, দাঁড়াতেও পারি না। আমরা সেবা দিচ্ছি, কিন্তু আমাদের জন্য অনেক কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।”
ঢাকার বাইরে থেকে অনেক শিশুকে রেফার অপ্রয়োজনীয় রেফার করা হচ্ছে বলেও মত দেন এই চিকিৎসক।
চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু অক্সিজেন প্রয়োজন শয্যা না থাকলেও এমন শিশুদের ভর্তি করে নেন তারা। কিন্তু বেশি গুরুতর শিশুদের ভর্তি করা যায় না, অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন তারা।
কোন ধরনের শিশুদের কৃত্রিম অক্সিজেন প্রয়োজন?
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাসপাতালে অক্সিজেন প্রয়োজন হয় এমন ৯০ শতাংশ শিশুই নিউমোনিয়া, ব্রংকিউলাইটিস এবং তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগে। বাকি ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্য কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে শ্বাসকষ্ট ভুগলে।
“সাধারণ শ্বাসকষ্ট হলে বাচ্চাদের অক্সিজেন দিতে হয়। আবার যখন তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়, সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেন সাপোর্ট তার অক্সিজেনের চাহিদা মেটাতে পারে না তখন আরেকটু হায়ার লেভেল অর্থাৎ ভেন্টিলেশন প্রয়োজন হয়।”
বেসরকারি হাসপাতালে বিলের চক্কর
সরকারি হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ না পেলে অগত্যা যেতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় অভিভাবকদের। কুমিল্লার বরুড়ার তাওসিনের পরিবারের মত যাদের একান্তই কিছু করার থাকে না তারা ভাগ্যের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে যায়।
গত ৮ অক্টোবর ঢাকার শ্যামলীর সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে কথা হয় ময়মনসিংহের তারাকান্দার মাদ্রাসা শিক্ষক লিটন মিয়ার সঙ্গে। তার এক বছর ৩ মাসের সন্তান হাসান জামিল এখানে ভর্তি।
জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকায় ৪ অক্টোবর জামিলকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা করা হয়। দুই দিন পর তাকে শিশু হাসপাতাল পাঠানো হয়। সেখানে ভর্তি করতে না পেরে পাশের এই বেসরকারি হাসপাতালে আসতে হয় বাবাকে।
লিটন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভর্তির সময় দিনে সাড়ে চার হাজার টাকা বিল আসবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরের দিন রাতে তাদের হাতে ৬৫ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এত টাকা কীভাবে দেবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় লিটন মিয়া।
“আমাদের খালি আইসিইউর চার্জের কথা বলেছিল। কিন্তু এখানে ভর্তির পর বলতেছে ডাক্তারের বিল, ওষুধসহ সবকিছুর বিল আলাদা দিতে হবে। আমি আত্মীয়-স্বজন যার কাছে যা পাইছি ধারদেনা করে ৩৫ হাজার টাকা নিয়া আসছি। বাকি টাকা কীভাবে দিমু মাথায় ধরতেছে না।”
পকেট ভারী রাখুন
নিউমোনিয়া,আরডিএস (রেসিপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম), এআরডিএসের (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম) মতো সমস্যা নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে আসা শিশুদের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। প্রতিদিন ওষুধ ছাড়াই মোটামুটি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিল হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ঢাকার ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসা ব্যয়ের একটা ধারণা দিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, চিকিৎসার খরচ অনেকটাই নির্ভর করে রোগের ধরনের ওপর। যদি ভেন্টিলেশন লাগে তাহলে প্রতিদিন ওষুধ ছাড়াই বিল আসবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
“ভেন্টিলেটর যদি না লাগে তাহলে খরচ কিছুটা কমে আসবে। আবার বাচ্চার অক্সিজেন যদি বেশি ৫ থেকে ১০ লিটার লাগে তখন আবার অক্সিজেনের দামও যোগ হবে। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকলে মোটামুটি এক লাখ টাকা খরচ হয়ে যাবে।
“তবে সেটা নির্ভর করে আরও কিছু বিষয়ের ওপর, যদি দামি কোনো ইনজেকশন দিতে হয় তাহলে খরচ আরও বাড়বে। ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসার ব্যয় কত হবে তা আপনি ব্লাইন্ডলি বলতে পারবেন না।”
এই চিকিৎসক বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য বাজেট, প্রস্তুতি রাখে না। স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় মনে হয় ব্যয় অনেক বেশি। কিন্তু বিদেশে এ ধরনের চিকিৎসার খরচ আরও বেশি।
“আমাদের সমস্যা হলো, হেলথ নিয়ে কেউ ভাবে না, চিকিৎসার জন্য টাকা রাখে না। নিয়মিত হেলথ চেকআপ করে না। এজন্য হঠাৎ কোনো একটা অসুখ হলে ঘরবাড়ি বিক্রি করতে হয়। হেলথ ইন্স্যুরেন্স খুবই জরুরি।”
ঢাকায় রোগীর চাপ এত বেশি কেন
শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আলাদা ব্যবস্থা নেই। জেলা সদর হাসপাতাল এবং জেনারেল হাসপাতালে যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এতে এ ধরনের শিশুদের উপজেলা থেকে জেলা এবং জেলা থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যার, বিভিন্ন জেলায় ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতালগুলো ১০০ শয্যার হয়।
উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসাব্যবস্থা কেমন জানতে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা গাজী মো. রফিকুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শিশুদের জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নেই। মেয়ে শিশুদের মহিলা এবং ছেলে শিশুদের পুরুষ ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
“শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিয়ে শিশু এলে আমরা জেনারেল ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেই। আমাদের অক্সিজেন লাইন টানা আছে, এরপরও অক্সিজেন প্রয়োজন হলে সিলিন্ডার দিই।”
জামালপুরের সিভিল সার্জন মো. ফজলুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে এনআইসিইউ এবং স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট (স্ক্যানু) শয্যা ৩২টি। সাধারণ বেড ২৪টি যাতে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। শনিবার সেখানে ২০৮ জন শিশু ভর্তি ছিল।
“উপজেলা পর্যায়ে শিশুদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। জেলা পর্যায়ে আছে। সেখানে এনআইসিইউতে একটা বেডে একটা বাচ্চা রাখতে হয়। বাকিগুলোতে একাধিক রোগী থাকে। আসলে রোগী আসে ৫-৭ গুণ বেশি রোগী আসে। যখন দেখি আর জায়গা হয় না তাদের ময়মনসিংহ পাঠিয়ে দিই।”
সমাধান কোথায়
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন বাংলাদেশ প্যাডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন-বিডিএর আহ্বায়ক অধ্যাপক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় সরকারি পর্যায়ে ভালো ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারার দায় সবার।
“শিশু হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল, বিএসএমএমইউ বা অন্য কোনো হাসপাতাল, শেষ পর্যন্ত বাসায়। যদি ভাগ্য ভালো তাহলে বাচ্চা বেঁচে যাবে, নইলে আল্লাহর বাচ্চা আল্লাহর কাছে চলে যাব।”
এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট কাটাতে করণীয় কী? এই প্রশ্নে শিশু বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, “অক্সিজেন সাপোর্ট আছে এমন বেডের সংখ্যা বাড়াতে হবে যাতে কোনো শিশু হাসপাতাল থেকে ফেরত না যায়।”
অধ্যাপক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “এটা বিরাট লোড, কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে বাজেট খুবই কম, এই বাজেটে সব শিশুকে এই ধরনের চিকিৎসা দেওয়া কঠিন। এর সমাধানে সরকারকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে, তবে সরকার যে খুব আন্তরিক তা মনে হচ্ছে না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু জাফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভালো চিকিৎসার আশায় সব রোগী ঢাকায় চলে আসে, কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। ডাক্তাররাও নিতে চান না। এ কারণে ঢাকায় চাপ বেশি। সরকারি হাসপাতালে রোগী ফেরত যেতে পারে না, এক বেডে তিনজন দেয়।”
তাহলে সমাধান কী- এই প্রশ্নে তার বক্তব্যে অনিশ্চয়তাও ফুটে উঠে। তিনি বলেন, “জেলা পর্যায়ে শিশু হাসপাতাল করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে তো অর্থের ব্যাপার আছে।”