“জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা না করলে ছাত্রজনতা আবারও রাজপথে নামতে বাধ্য হবে।”
Published : 31 Dec 2024, 06:42 PM
বছরের শেষ দিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো ছাত্র-জনতার সমাবেশে ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ ঘোষণার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ দিন সময় ঠিক করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
মঙ্গলবার বিকেলে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “এতদিন আমাদের ঘোষণাপত্র ছিল না। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে। এই সময় পর্যন্ত সবাই জেলা, উপজেলা থানা পর্যায়ে এটিকে পৌঁছে দেবেন। মুজববাদীদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম জারি থাকবে।”
এসময় তিনি উপস্থিত জনতার সঙ্গে হাত তুলে বিচার ও সংস্কারের শপথ করেন। স্লোগান দিয়ে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে দরকার, বিচার আর সংস্কার।”
সমবেতদের উদ্দেশে হাসনাত বলেন, “আপনারা জুলাই ঘোষণাপত্রের কথা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মানুষের কাছে যাবেন। তাদের কথা শুনবেন এবং তাদের কথা তুলে আনবেন।”
নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ জুলাই ঘোষণাপত্র চায়। তারা সংস্কার চায়, নতুন সংবিধান চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার ঘোষণা দিয়েছে, তখন সরকার সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি বিজয়।”
তিনি বলেন, “সরকারকে জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জুলাইয়ের প্রোক্লেমেশন ঘোষণা করতে হবে। আমাদেরকে বলা হয়, নতুন সংবিধান করবে তার ম্যান্ডেট কোথায়? আমরা বলি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন।
“নির্বাচনে যারা জয়ী হবে, তারা একইসাথে সংবিধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন সংবিধান গঠন করবে এবং আইনসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের বিচার, সংস্কারসহ নানা আকাঙ্ক্ষা চাওয়া আছে। ছাত্রজনতা অবশ্যই তাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে।”
মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি থেকেই মঙ্গলবার ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের ঘোষণা ছিল। সেই প্রস্তুতি নিয়ে সারা দেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে শহীদ মিনারে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
বলা হয়েছিল, এই ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ হবে ‘আগামীর বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র’। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে এর মাধ্যমে ‘নাৎসি বাহিনীর’ মত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করা হবে। একইসঙ্গে ১৯৭২ সালের ‘মুজিববাদী’ সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।
ঐকমত্য গঠনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছিল ঘোষণাপত্রের খসড়া। সেখানে বলা হয়েছিল, “আমরা নিজেদের স্বাধীন সার্বভৌম জনগণ হিসেবে ঘোষণা করলাম।”
মঙ্গলবারের এই কর্মসূচি নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনার মধ্যে গত রোববার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু এক দিনের ব্যবধানে সোমবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে একই ধরনের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এক বিফ্রিংয়ে তিনি বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে।
''আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।''
এরপর গভীর রাতে জরুরি বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা দেয়, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তারা তাতেই সমর্থন দেবে।
অর্থাৎ, ঘোষণাপত্র সরকারই দেবে। তবে মঙ্গলবার শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিও বহাল থাকবে।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই থেকেই এ কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে জড়ো হতে থাকে ছাত্র-জনতা।
তারা ‘দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ', ‘উই ওয়ান্ট উই ওয়ান্ট, জাস্টিস, জাস্টিস, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ' ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
পূর্ব নির্ধারিত সময় বিকাল ৩টার মধ্যেই শহীদ মিনারসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এরপর বিকাল ৪টায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় কর্মসূচি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানকে অনেকে মেনে নিতে পারে নাই, তাই বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাদের রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সচিবালয় থেকে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আগে আমরা দেখেছি সতীদাহ প্রথা, এখন দেখছি নথিদাহ প্রথা।”
তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও মতকে শেখ হাসিনা দমন করেছে। আমাদের নেতৃত্বে মানুষ মাঠে নেমে এসেছে, শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তার পুনর্বাসন এই দেশে আর হবে না। পিলখানা, শাপলাসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় নাই, এসবের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। গত ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের গুম-খুন-নিপীড়নের বিচার করতে হবে। এ সব দাবিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব।”
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, “আগামীতে যে ঘোষণাপত্র আসবে, সেখানে প্রত্যেক শহীদের রক্তের ফোটার কথা উল্লেখ থাকতে হবে। যদি আমরা সে কথাগুলো না পাই, তাহলে বাংলার চব্বিশের বাঘের বাচ্চারা তা মেনে নেবে না। ঘোষণাপত্রে ৫৩ বছরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়েছে, তা সংস্কারের ইঙ্গিত থাকতে হবে। আমরা এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই।”
তিনি বলেন, “নতুন বাংলাদেশে কোনো শহীদ বা আহতের উপর চোখ রাঙানো চলবে না। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি হবে না।”
সরকারের উদ্দেশ্যে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বলেন, “আপনারা অতিদ্রুত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে সক্রিয় হোন। সক্রিয় না হলে চব্বিশের বাঘের বাচ্চারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেবে। আমাদের আগামীর কাজ হবে শেখ হাসিনাকে বাংলার মাটিতে এনে বিচার নিশ্চিত করা। বিচারিক প্রক্রিয়ায় (আওয়ামী লীগকে) নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, “আমরা অভ্যুত্থানে ঘোষণা দিয়েছিলাম নতুন বন্দোবস্ত চাই, দেশের সব মানুষ এই ডাকে সাড়া দিয়ে এসে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করেছে। এই জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমাদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র।”
বাগেরহাটে ‘মার্চ ফর ইউনিটি' কর্মসূচিতে অংশ নিতে আসা বাসে হামলার ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ভাইদের খুন করেও উন্মুক্তভাবে ঘুরছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে স্পস্ট করে বলতে চাই, যেসব খুনিরা বিদেশে পালিয়ে গেছে, তাদের ফেরত আনতে হবে, তাদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে হবে। গোপালগঞ্জে লুকিয়ে থাকা তাদের দোসরদের গ্রেফতার করতে হবে।”
নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, “জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা না করলে ছাত্রজনতা আবারও রাজপথে নামতে বাধ্য হবে। ছাত্রজনতার প্রতি অনুরোধ, আপনারা বিচার ও সংস্কার নিশ্চিত না করে রাজপথ ছাড়বেন না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, “আমরা রীতিমত বাধ্য হয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছি। ৫ অগাস্টের পর পাঁচ মাস পর এই ঘোষণাপত্রের উদ্যোগ নিতে হল। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতের আগে কোনো নির্বাচন হবে না।”
কর্মসূচির উদ্ধোধনী বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা আবুল হাসান।
এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম, গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধি শ্যামলী সুলতানা, নাঈম আবেদীন, গণঅভ্যুত্থানে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ, আতিকুল গাজী, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি, কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রিফাত রশীদ, মাহিন সরকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেল খাটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বক্তব্য দেন।
পুরনো খবর...
জুলাই ঘোষণাপত্র সরকারই দেবে, সমর্থনে কর্মসূচিও হবে: বৈষম্যবিরোধী
'জুলাই ঘোষণাপত্র' দিয়ে আওয়ামী লীগকে 'অপ্রাসঙ্গিক' করা হবে: হাসনাত
'জুলাই বিপ্লব ঘোষণাপত্রের' সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নেই: প্রেস সচিব
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র: আড়াই লাখ মানুষ জমায়েতের পরিকল্পনা