গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে সচিবালয়ে কড়া নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার পরও এই প্রথম ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটল।
Published : 27 Dec 2024, 02:05 AM
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের একটি ভবনের চারটি তলা প্রায় ১০ ঘণ্টা আগুনে পোড়ার পর কেপিআই বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে সেখানকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; এটি দুর্ঘটনা না কি নাশকতা সামনে এসেছে সেই আলোচনাও।
বহিঃনিরাপত্তার পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা থাকা সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে কেন হিমশিম খেলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা, সেই প্রশ্নও ঘুরে ফিরে করা হচ্ছে।
গভীর রাতের আগুনে দীর্ঘ সময় ধরে পুড়ল পাঁচ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সব নথি; সেগুলো উদ্ধার হবে কীভাবে তা চিন্তায় ফেলেছে সরকারকেও।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলছেন, ১০ তলা ভবনের উপরের দিকে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢোকাতে বেগ পেতে হয়েছে তাদের।
ভেতরে পানির উৎস পাওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়ার কথা বলছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা; বাইরে সড়কের উপর পানির লাইন টানতে গিয়ে ট্রাকচাপায় প্রাণ গেছে তাদের এক ফায়ার ফাইটারের।
ফায়ার সার্ভিস ধারণা করছে, কাগজপত্রের পাশাপাশি দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন ব্যাপক হয়েছে। পুড়ে ছাঁই হয়েছে বিপুল নথিপত্র।
বুধবার গভীর রাতে সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবন থেকে এ আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১২টায় আগুন নেভানো সম্ভব হয়।
বহুতল এ ভবনে অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।
সচিবালয়ে ভয়াবহ এই আগুন নিছক দুর্ঘটনা না কি নাশকতা, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার সন্দেহ ফায়ার সার্ভিস করলেও নাশকতা হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলছে আগুন নেভাতে আসা নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তার কথায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও এটাকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। তবে ঘটনার সূত্রপাত বোঝার জন্য তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষার কথা বলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিন দিনেই প্রাথমিক প্রতিবেদন মিলবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কেপিআই এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও এমন ব্যাপক আগুনের ঘটনায় নিরাপত্তা ও ভবন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সবাইকে জবাবদিহিতার আওতার আনার কথা বলছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মোঃ শাহিদউল্লাহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, পুরো সচিবালয় হল একটা কেপিআই বা কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন। এখানে অগ্নিনিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কথা।
“ফায়ার সার্ভিস তো অবশ্যই। নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে পুলিশ, সব রকম নিরাপত্তা বাহিনী থাকবে, এমনকি সশস্ত্র বাহিনীকেও কেপিআইয়ের লিস্ট দেওয়া হয় এবং তাদেরও বিকল্প পরিকল্পনা থাকে। সার্বিকভাবে এটা তদন্ত হওয়া দরকার। এবং একটা বিভাগ না, সবগুলো বিভাগকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন আন্দোলন, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ সামলাতে হচ্ছে সরকারকে। সরকারের উপদেষ্টারা এবং আন্দোলনের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসরদের’ বিভিন্ন দপ্তরে ‘ঘাপটি মেরে’ থাকা ও তাদের ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা বলে আসছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসের মধ্যে সচিবালয়ে মত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটল।
২০১৩ সালের কেপিআই নীতিমালায় বলা হয়েছে, কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই) হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারখানা বা জনস্বার্থে ব্যবহৃত স্থাপনা যেগুলো দেশের যুদ্ধ সামর্থ্য অথবা জাতীয় অর্থনীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের যুদ্ধ কিংবা প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বা জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কেপিআই চত্বরে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন এবং এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে নিকটতম ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে ন্যূনতম বছরে দুই বার মহড়া করার কথাও বলা হয়েছে ওই নীতিমালায়।
অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বিষয়ে সচিবালয়ের দেখভালকারী গণপূর্ত অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হলেও তারা ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা বলছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক শাহিদউল্লাহ।
তিনি বলেন, “সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য গেইট করা হল, ছাউনি দেওয়া হল। এখানে কিন্তু ফায়ার সার্ভিস পত্র দিয়েছে বলে আমি জানতে পেরেছি। এই ছাউনিটা যে টার্নটেবিল ল্যাডারকে বাধাগ্রস্ত করছে, সেটা জানানো হয়েছে।”
সচিবালয়ে এটি প্রথম বড় ধরনের আগুনের ঘটনা বলে তুলে ধরে তিনি বলেন, “এর আগে সচিবালয়ে এতবড় আগুনের ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি।”
দুর্ঘটনা না কি নাশকতা?
সচিবালয়ের এই আগুন নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে কারণ জানতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষার কথা বলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
রাষ্ট্রের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গভীর রাতে আগুন লাগার কারণ নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন সন্দেহের কথা বলছেন। আগের সরকারের ‘দুর্নীতির প্রমাণ নষ্ট করতে’ আগুন লাগানো হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার সকালে নিজের ফেইসবুকে লিখেছেন, “স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থলোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল।
“আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি। আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।”
আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেওয়া নৌবাহিনীর দলে থাকা সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার মো. আমিনুল ইসলামও বলেছেন, তার কাছে এটা নাশকতা বলে মনে হয়েছে।
“শর্ট সার্কিট থেকে নয়। মনে হল, পরিকল্পিতভাবে লাগছে। মনে হল বিভিন্ন জায়গা থেকে হয়েছে। শর্ট সার্কিট হলে একটা জায়গা থেকে হয়। এক জায়গা থেকে নয়, এটা হয়েছে কয়েকটা জায়গা থেকে।”
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল অবশ্য এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, যেভাবে আগুন ছড়িয়েছে সেটা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কারণে হতে পারে। এক জায়গা আগুন ধরলে বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে সব জায়গা ছড়িয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এরকম ঘটতে পারে। তবে তদন্ত শেষ না করে নিশ্চিত কিছু বলা যাবে না।
তিনি বলেন, “আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, তিনটি জায়গায় একসাথে আগুন দেখা গেছে। যখন স্পার্কিং হয়, যদি বিদ্যুৎ লাইনের শর্টসার্কিট হয়, এটা হতে পারে। তবে আমরা এটা এখনও নিশ্চিত বলব না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তদন্ত শেষ করছি। কিন্তু এটা হতে পারে। এটা হয়েছে আমরা বলব না।
“যদি শর্ট সার্কিটের বিষয় থেকে থাকে, যদি একই লাইন হয়ে থাকে, তাহলে এটা হতে পারে।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে তদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছেন।
বৃহষ্পতিবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকের পর ব্রিফিং করেন পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং স্থানীয় সরকার এবং ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সরকার কী ধারণা করছে, এমন প্রশ্নে রিজওয়ানা হাসান বলেন, “সরকার এভাবে ধারণা করতে পারে না। সরকার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। কারণ এটা আমাদের সকল প্রকার নিরাপত্তার বিষয় এবং এখানে রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলো থাকে।
“ফলে এ বিষয়টিকে সরকার খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। যার জন্য তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে।”
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের বিভাগের করা সাত সদস্যের কমিটি বাদ দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। এই কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগা এবং দুই প্রান্তে আগুনের বিষয়ে জানতে চাইলে রিজওয়ানা বলেন, “আগুনটা আরও আগে নেভানো যেতো কিনা, আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়েছে কিনা— এগুলো কমিটির প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আমরা উত্তর দিতে পারব না।”
সাংবাদিক বা অন্য কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে সেগুলো সরকার বা তদন্ত সংস্থাকে জানানোর কথা বলেন উপদেষ্টা।
আগুনের ধরন দেখে নাশকতার বিষয়টি এড়িয়ে দেওয়া যায় না মনে করছেন অগ্নি নির্বাপণ বিশেষজ্ঞ আবু নাঈম মোঃ শাহিদউল্লাহ। তিনি বলেন, “তদন্ত কমিটিকে প্রথমেই নাশকতার বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত করতে হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বারুদ বা কেমিকেল দিয়ে যেমন নাশকতা করা যায়। তেমনি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেও বৈদ্যুতিক শর্ট সাকিট ঘটিয়ে নাশকতা করার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য তদন্ত কমিটিকে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। আর ভবনগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পালন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর বলেন, “সচিবালয়ের নিরাপত্তার জন্য একজন করে এসপি ও এএসপি থাকে; এছাড়া প্রায় ৫৬০ জনের মত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আছে।”
আগুনের ঘটনা তদন্তে ভেতরে থাকা ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ এরই মধ্যে সংগ্রহ করার কথা বলেন তিনি।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সচিবালয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখেন। যে কোনো কক্ষে কোনো কর্মকর্তা প্রবেশ করার ক্ষেত্রে সাধারণত তিনটি তালাযুক্ত ফটক বা দরজা পেরিয়ে ঢুকতে হয়।
“সচিবালয়ের মূল ফটকগুলো আর প্রত্যেকটা ভবনের কলাপসিবল গেইটের চাবি থাকে পুলিশের কাছে এবং অফিস কক্ষগুলোর চাবি থাকে গণপূর্ত বিভাগের কাছে। আর যে কোনো কর্মকর্তা বা অফিস সহকারীর কাছে কেবল কর্মকর্তার কক্ষের চাবি থাকে।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, এই প্রক্রিয়ায় সকালে অফিস খোলা ও ছুটির সময় বন্ধ করা হয়। ছুটির দিনে যদি কারও অফিস করতে হয়, সেই ব্যবস্থা করে দিতে পুলিশ এবং গণপূর্তকে আগে থেকে জানাতে হয়। এরপর তারা ঢোকার ব্যবস্থা করে থাকে।
সচিবালয়ের ৯ নম্বর ভবনের তথ্য অধিদপ্তর এবং এর লাগোয়া ৪ নম্বর ভবনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগের কার্যালয় সপ্তাহে প্রতিদিনই খোলা থাকে বলে জানান একজন তথ্য কর্মকর্তা।
আগুনের ঘটনাটি নাশকতা হতে পারে সন্দেহ প্রকাশ করে সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তা ফেইসবুকে তুলে ধরেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ইমরুল হাসান।
তিনি লিখেছেন, “সচিবালয়ের সমস্ত বিল্ডিং, ইন্টেরিয়র, স্থাবর সমস্ত কিছুর দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের। এর নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের।
“আমি ও আমরা যে রুমগুলোতে বসি তার চাবিও আমার বা আমাদের স্টাফের কাছে থাকে না। গণপূর্ত যদি রুম খুলে না দেয় তো আমার অফিস করাও সম্ভব না!”
তিনি বলেন, “কখনও জরুরি প্রয়োজনে রাতে কোনো রুম খুলতে হলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের স্টাফ যাদের কাছে চাবি থাকে, তাদেরকে বললে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রেজিস্টার খাতায় নাম, পরিচয় লিখে- স্বাক্ষর দিয়ে রুমে ঢুকতে হয়। চাবি কিন্তু তাদের কাছেই থাকে, রুম খোলা- বন্ধ তারাই করেন।
“রাত গভীরে আগুন লাগাটা কোন গেমের অংশ হতেই পারে, সাবোটাজও হতে পারে। প্রত্যাশা- তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে।”
ক্ষয়ক্ষতি
১০ ঘন্টার আগুনে সচিবালয়ের চারটি তলার পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নথির পাশাপাশি আসবাবপত্র পুড়ে ছাঁই হওয়ার কথা বলেছেন কর্মকর্তারা।
ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, করিডরের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের রুমগুলোর কোনটি পুরোপুরি, আবার কোনটি আংশিক ভস্মিভূত হয়েছে। তবে করিডরের সিলিং ও দুইপাশের সাজসজ্জা ধ্বংস হওয়ায় তা হাঁটাচলার অনুপযোগী হয়ে গেছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগুন লাগার পর তারা কেউ আর মন্ত্রণালয়ের ঢোকার অনুমোদন পাননি। সেখানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে যাওয়ার অবস্থা ছিল না।
ভবনের অষ্টম তলার পূর্ব অংশে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কয়েকটি দপ্তর। আরও রয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দপ্তর। এই তলার পশ্চিম অংশ জুড়ে রয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের দপ্তর।
আগুনে নাহিদ ইসলামের দপ্তর ও এর আশপাশের রুমগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা।
অন্যদের মতো তিনিও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে পারেননি। তবে সেখানকার ভিডিও থেকে দেখা অভিজ্ঞতার আলোকে এই কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের দপ্তর পুরোপুরি ভস্মিভূত হয়েছে বলে তারা শুনেছেন। আশপাশের রুমও পুড়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের মো. মুশফিকুর রহমানের একান্ত সচিব মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান বলেছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে তারা সারা দিন নিজেদের দপ্তরে যেতে পারেননি। সচিবের রুম পাঁচ তলায় আর উপদেষ্টার রুম সাত তলায়। পাঁচ তলার দিকে আগুন ছড়ায়নি বিধায় এখানে ক্ষয়ক্ষতি কম। আগুন নেভাতে গিয়ে কিছু পানি হয়তো এসেছে। তবে উপদেষ্টার দপ্তরের দিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে শুনেছেন।
পুরো সপ্তম তলা জুড়ে রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, যার উপদেষ্টা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আগুনে এই মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের অধিকাংশ জিনিসপত্র জুড়ে গেছে বলে উপদেষ্টা নিজেই জানিয়েছেন।
ষষ্ঠ তলার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও রয়েছেন আসিফ মাহমুদ।
শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তারা ঘটনাস্থলের কোনো ছবি বা ভিডিও পাননি। তবে শুনেছেন অনেক কক্ষ সম্পূর্ণ, আবার কোনোটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নথি পুড়ে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “প্রায় পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে গেছে। এর মধ্যে আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যুব ও ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
“এছাড়া সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং বাকি তিনটা মন্ত্রণালয়- এই মোট পাঁচটা মন্ত্রণালয়ের নথিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
এর মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নথির কার্যক্রম অনলাইনে থাকার কারণে, সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলেছেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, “কিন্তু স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পুরোটা অ্যানালগভাবে হয়, পুরোটাই ফাইলে হয়। সুতরাং যে শাখাগুলোর নথি পুড়ে গেছে, সেগুলো কতটা রিকভার করা যাবে, সেটার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করার জন্য আমাদের মন্ত্রণালয় পর্যায়ে একটা কমিটি আমরা করেছি।
“সেই কমিটি কাজ করে একটা রিপোর্ট প্রদান করলে আমরা বুঝতে পারব, আসলে আমাদের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কোনটা উদ্ধারযোগ্য আর কোনটা উদ্ধারযোগ্য না।”
পুড়ে যাওয়া বিভাগগুলোর কাজ চলবে কীভাবে?
কয়েকটি ভবনে বিদ্যুৎ না থাকায় বড়দিনের ছুটির পর বৃহস্পতিবার সচিবালয়ের কাজকর্ম কার্যত বন্ধ ছিল।
সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার অফিস সূচি অনুযায়ী সকালেই সচিবালয়ে হাজির হন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মীরা। কিন্তু কেবল একটি গেইট খোলা থাকায় সামনের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের জটলা তৈরি হয়।
সেই ভিড় পেরিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভেতরে ঢুকলেও দাপ্তরিক কার্যক্রম না হওয়ায় অনেকেই আবার বেরিয়ে পড়েন। লিফট বন্ধ থাকায় বিভিন্ন উঁচু ভবনে না উঠে অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীকে ভেতরের উন্মুক্ত স্থানে বসে থাকতে দেখা যায়।
বিকল্প সংযোগ বা জেনারেটরের মাধ্যমে যেসব ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল, সেখানে কার্যক্রম চলার কথা জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সাত নম্বর ভবনে যে পাঁচ মন্ত্রণালয় বা বিভাগ একেবারে পুড়ে ছাঁই হয়েছে, সাপ্তাহিক ছুটির পর রোববার থেকে সেগুলোর কার্যক্রম কীভাবে চলবে, এমন প্রশ্নে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য, কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য অন্যান্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তর যেখানে জায়গা খালি আছে, সেই জায়গাগুলোতে রিলোকেট করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।
“আমরা ইতোমধ্যে খুঁজে দেখছি, কোথায় কোথায় খালি আছে, কোথায় মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে পরিচালনা করা যায়।”
আগুনে কোন মন্ত্রণালয়ের কতটা ক্ষতি?
সচিবালয়ে আগুনে নিরাপত্তার ‘ব্যত্যয়’? ‘প্রশ্নটা আমাদেরও’, বললেন রিজওয়ানা
সচিবালয়ে আগুন: সংগ্রহ করা হয়েছে সিসিটিভি ভিডিও
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড: এখনও জানা যায়নি ভবনের ক্ষয়ক্ষতি
সচিবালয়ে আগুন: আগের তদন্ত কমিটি বাদ দিয়ে নতুন কমিটি
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড: উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন, ৩ দিনে প্রাথমিক প্রতিবেদন
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড: ‘নিশ্চিত’ ষড়যন্ত্র দেখছেন সারজিস আলম
সচিবালয়ে আগুন: ক্ষতিগ্রস্ত দপ্তরের কাজ যেভাবে চলবে
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড: মন্ত্রণালয়ভিত্তিক তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড: মিলেছে কুকুর ও কবুতরের দেহাবশেষ
সচিবালয়ে আগুন: যা বললেন স্থানীয়রা
ফায়ার ফাইটার নয়নের জানাজায় উপদেষ্টা, বললেন ‘আমাদেরই ব্যর্থতা’
সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড 'পরিকল্পিত' মনে হচ্ছে নৌবাহিনী কর্মকর্তার কাছে