গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনে বিল সংসদে, জাপা এমপির আপত্তি

নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ নাকচ করেছেন আইনমন্ত্রী।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2023, 04:01 PM
Updated : 5 June 2023, 04:01 PM

ভোট স্থগিতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার কিছু পুনর্বিন্যাস করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনে সংসদে বিল উঠেছে।

সোমবার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি সংসদে তোলেন।

এই সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ‘খর্ব করা হচ্ছে’- এমন অভিযোগ করে বিলটি উত্থাপনে আপত্তি জানান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।

তবে তা নাকচ করে আইনমন্ত্রী বলেছেন, এর মাধ্যমে বরং ইসি ‘শক্তিশালী’ হবে।

বিলটি উত্থাপন না করতে ফখরুল ইমামের প্রস্তাব স্পিকার ভোটে দিলে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তখন আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে তোলেন।

এরপর সেটি পরীক্ষা করে ১৫ দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

নির্বাচনী আইনটিতে প্রস্তাবিত সংশোধনে ৯১ (ক) অনুচ্ছেদেএকটি উপধারা যুক্ত করা হচ্ছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমত সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।

এর সঙ্গে একটি উপধারা যোগ হচ্ছে, তাতে বলা হয়েছে, শুধু কয়েকটি কেন্দ্রের গোলযোগ-জবরদস্তির জন্য পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা যাবে না। সেই সব কেন্দ্রের ভোটই বন্ধ করা যাবে, যেসব কেন্দ্রের ভোট গ্রহণে অভিযোগ নেই, তা স্থগিত করা যাবে না।

Also Read: ৯১ ই: ‘কাট-পেস্ট’ থেকে ভুল বোঝাবুঝি!

Also Read: ভোট স্থগিতে ইসির ক্ষমতা আগের মতই থাকল

এই সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে দুই ধরনের মত আসছে। কেউ কেউ বলছেন, এতে ইসির ক্ষমতা খর্ব হবে। অন্য পক্ষ বলছে, এতদিন আইনের এই ধারায় অস্পষ্টতা ছিল। এখন কোন কোন ক্ষেত্রে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হচ্ছে।

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের এই সংশোধন আসছে। গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ওই উপনির্বাচনে ইসি এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রে অনিয়ম দেখে গোটা আসনের ভোট বন্ধ করে দিয়েছিল।

ইসির ক্ষমতা খর্ব হবে: ফখরুল

বিলের উত্থাপনে আপত্তি জানিয়ে জাতীয় পার্টির নেতা ফখরুল ইমাম বলেন, “আজ আরপিও দেখলাম, কিছুদিন আগে গাইবান্ধা উপনির্বাচন হয়েছে। সেটা ইসি বন্ধ করে দিয়েছে। আমি জানি না, কী কারণে মাননীয় মন্ত্রী এটা আনলেন যে ইসি পুরো নির্বাচনী এলাকা বন্ধ করতে পারবে না। শুধু কেন্দ্রগুলো যেখানে গণ্ডগোল হয়েছে, সেখানে বন্ধ করতে পারবে। এটা স্বাধীতার হস্তক্ষেপ।”

প্রস্তাবিত বিলে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “ইসি যদি মনে করে সকাল থেকে এখানে আরও অনেক গণ্ডগোল হবে, পরিবেশ খারাপ যেটা গাইবান্ধায় হয়েছিল। দুই-তিনটির পরে তারা বন্ধ করে দিতে পারবে, সে স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে।”

ইসি শক্তিশালী হবে: আইনমন্ত্রী

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যের বক্তব্য নাকচ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “জোর জবরদস্তি, গোলযোগ, সহিংসতায় তদন্ত সাপেক্ষে পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা (আরপিও ৯১ এ অনুচ্ছেদ) নির্বাচন কমিশনের রয়েছে।

“তবে নতুন করে একটা সংশোধনী আনা হয়েছে, যাতে যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে সেগুলো বন্ধ করতে পারবে। একই আসনের যেখানে সঠিক নির্বাচন হয়েছে, তা বন্ধ করার ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়নি। এটাকে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি, বরং ইসিকে শক্তিশালী করা হয়েছে।”

নতুন করে প্রস্তাব করা ৯১ (এ) উপধারা নিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “কোনো একটা পোলিং সেন্টারে যদি গণ্ডগোল দেখা যায়; ধরুন আমার নির্বাচনী এলাকায় ১১৪টি কেন্দ্র রয়েছে। এখানে যদি দুটো কি তিনটায় গণ্ডগোল হয়, সহিংসতা- জবরদস্তি ঘটনা ঘটে; তাহলে এই দুই-তিনটা কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করতে পারে ইসি। কিন্তু এ দুটো-তিনটার কারণে ১১১টা কেন্দ্রে যে সঠিক নির্বাচন হয়েছে, সেটা বন্ধ করার ক্ষমতাটা এ আইনে (দেওয়া হয়নি)। এখানে যে ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে সেটা দেওয়া হচ্ছে না।

“১১১ টা কেন্দ্রে সঠিক নির্বাচন হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে, সেটা ইসি বন্ধ করতে পারবে না। যদি বন্ধ করতে পারত সেটা অগণতান্ত্রিক।”

আর পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট বন্ধে ইসির বিদ্যমান ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে না দাবি করে আনিসুল হক বলেন, “ইসি যদি দেখে কোনো নির্বাচনী এলাকায় সমস্যা হয়, জবরদস্তি থাকে, গণ্ডগোল, ভোটদানে বাধা দান হলে পুরো নির্বাচনী এলাকা বন্ধ করে দিতে পারবে।”

সংশোধনের প্রক্রিয়া

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী আইনে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব গত ২৮ মার্চ নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

সংসদে উত্থাপিত বিলটি নিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আরপিওর এ সংশোধনীতে ইসির ক্ষমতা একদিকে বেড়েছে, আবার একদিকে খর্ব করা হয়েছে। তাতে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।

তার ভাষ্যে, আইনের ৯১(এ) অনুচ্ছেদে যদি ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে ইসি শুধু ভোট চলাকালীন নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে। আর ‘ইলেকশন’ শব্দ থাকলে যে কোনো পর্যায়ে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা কিছুটা কমেছে।

“আর ভোট শেষে গেজেট প্রকাশের আগ পর্যন্ত অভিযোগ আমলে নিয়ে বন্ধ করার ৯১ এ-তে যুক্ত হওয়ায় ক্ষমতা কিছুটা বেড়েছে।”

ইসি কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনের একটি পর্যায় হল ‘পোলিং’। পোলিং অর্থ ভোটের দিন ভোট নেওয়ার সময়টুকু বোঝায়। আর ‘ইলেকশন’ অর্থ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সময়।

প্রস্তাবিত বিলে টিআইএন এবং ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের কপি জমা, প্রার্থিতা বাছাইয়ে বৈধ হলেও তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ, দল নিবন্ধনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুত লক্ষ্যমাত্রা ২০২০ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সাল করা এবং ভোটের সংবাদ সংগ্রহে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের কাজে বাধা দিলে কিংবা যন্ত্রপাতি বিনষ্ট করলে শাস্তি-সাজার বিধানসহ কয়েকটি প্রস্তাব রয়েছে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রস্তাবগুলো সংযোজন বা বিয়োজন হতে পারে। সবশেষে বিল আকারে পাসের উপস্থাপন হবে।