অধিকারকর্মী, গবেষক এবং বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বলছেন, ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না- এমন কথা সংবিধানে কোথাও নেই।
Published : 29 Jul 2022, 09:50 PM
আন্তর্জাতিক ‘আদিবাসী’ দিবস উপলক্ষে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে গিয়ে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার যে নির্দেশনা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় জারি করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অধিকারকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক এবং বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা।
ক্ষমতাসীন দলের জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশাও বলেছেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনা তিনি যৌক্তিক মনে করেন না।
আগামী ৯ অগাস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস সামনে রেখে ওই নির্দেশনায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্য ব্যক্তিদের’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতালসহ সরকার স্বীকৃত ৫০টি ‘নৃগোষ্ঠী’র প্রতিনিধিদের পাশাপাশি এসব নৃগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করেন- এমন বাঙালি গবেষকরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিষয়টি নিয়ে।
গত ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের টিভি-২ শাখার উপসচিব শেখ শামছুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
“এ অবস্থায় আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টক শোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্য ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।”
নির্দেশনাটি পাঠানো হয়েছে মূলত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন টেলিভিশন স্টেশনের প্রধানদের কাছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক সোহরাব হোসেনও ওই চিঠি পাওয়ার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে স্বীকার করেছেন।
২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩(ক) ধারায় সংস্কৃতি সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়, “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপ-জাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
সংশোধনীর পর ’আদিবাসী’দের পরিচয় নিয়ে নানান আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে প্রচারমাধ্যমগুলোকে আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হয় বিভিন্ন সময়ে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন মনে করেন, এটা তাদের জাতিগত পরিচয় প্রকাশের ‘স্বাধীনতা-পরিপন্থি’।
“কিছুদিন পরপরই আমাদের অপমান করে একেকটা নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। আমি এর তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই। আমরা আদিবাসীরা এটা মানি না। যতদিন জীবন থাকবে, আমরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবেই পরিচয় দেব।
“একটা গণতান্ত্রিক দেশে কোন গোষ্ঠী নিজেদেরকে কী নামে ডাকবে, এটা কি সরকার নির্ধারণ করতে পারে? এমনিতেই আমরা রাষ্ট্রে দুই নম্বর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছি। তার মধ্যে একের পর এক অপমানজনক বিধিনিষেধ জারি করা হলে এদেশকে আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র কেন বলব? আমরা সংখ্যায় কম বলে আমাদের মুখ এভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব না।”
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে সম্বোধন করবেন, সেটি ঠিক করার দায়িত্ব তথ্য মন্ত্রণালয়ের নয়।
“তাদের কোনো এখতিয়ারও নেই। এ ধরনের নির্দেশনা সম্পূর্ণ অযাচিত এবং এদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য অবমাননাকর।”
পাশের দেশ ভারতের সংবিধানের কথা তুলে করে সঞ্জীব দ্রং বলেন, “ভারতের সংবিধানেও কোথাও আদিবাসী কিংবা উপজাতি শব্দ উল্লেখ করা নেই। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে গণমাধ্যমগুলোতেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।”
প্রতিটি জাতিই তার নিজস্ব পরিচয় প্রকাশের, প্রচারের অধিকার রাখে মন্তব্য করে আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা বলেন, “এই প্রজ্ঞাপন মোটাদাগে জাতিগত পরিচয় প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নকারী এবং এর মাধ্যমে প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।”
টিভি টকশোতে কে কী বলবেন সেটা মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারণ করে দেওয়ার এমন ‘রেওয়াজ’ দেখে ‘বিস্মিত হচ্ছেন’ বলে জানালেন দীপায়ন খীসা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভেজ হাসেম বলেন, “এ নির্দেশনা গণমাধ্যমের ওপরও এক ধরনের হস্তক্ষেপ।… গণমাধ্যমের নিজস্ব রীতিনীতি মেনে চলার এবং শব্দচয়নের অধিকার রয়েছে।”
আর পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, মানুষ নিয়মিত এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করে, যা সংবিধানে নেই।
“আমার পরিচয় প্রকাশ করতে আমি কোন শব্দ ব্যবহার করব, সেটি রাষ্ট্র কোনোভাবেই ঠিক করতে পারে না। এতে আমাদের হেয় করা হয়েছে।”
নির্দেশনাটি সংবিধানের সাথেও ‘সাংঘর্ষিক’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ।
তিনি বলেন, “সংবিধানের একটা সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে’ উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হবে। কিন্তু সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি যে এই উপ ও ক্ষুদ্র বলে অভিহিত আমরা নিজেকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবি করতে পারব না।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, তথ্য মন্ত্রণালয় ওই নির্দেশনা জারির ক্ষেত্রে সংবিধানের যে ধারাটির উল্লেখ করেছে, সেটা ‘অনেকটাই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে’ সেখানে।
“আদিবাসী শব্দটির ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞাটা তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থেকে এসেছে, সেটি জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী আদিবাসী অধিকার রক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক”। আমাদের সংবিধানের কোথাও এ কথাও উল্লেখ নেই যে ‘আদিবাসী’ শব্দটি কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। কেউ যদি এই শব্দটি ব্যবহার করে, সেটি কীভাবে সংবিধানের পরিপন্থি হয়, আদেশ-নির্দেশ বা প্রজ্ঞাপন জারির আগে মন্ত্রণালয় কেন সে বিষয়ে অবগত করে না?”
নির্দেশনাটি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন আদিবাসী বিষয়ক লেখক ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল।
তিনি বলেন, “২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী তার শুভেচ্ছাবাণীতে স্পষ্টভাবেই ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করতে নারাজ।”
তথ্য মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা ‘চিন্তাক্ষেত্রকে সংকুচিত করে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“চিন্তক, বুদ্ধিজীবীরা কোন শব্দ ব্যবহার করে কাউকে সম্বোধন করবে, সেটা মন্ত্রণালয় কীভাবে নির্ধারণ করে দেয়? সমাজবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, ইতিহাসের একজন অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসেবে আমার নিজের অনেক ভিন্নমত রয়েছে। রাষ্ট্র বলতে চায় বাংলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। কিন্তু আমাদের দেশের সমতলে, পাহাড়ে সবখানেই আদিবাসীদের নানা গোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।
“যদি আমরা সময়ের বিবেচনায় দেখি, তাহলেও দেখব সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, ভীল, কোলসহ আরও অনেক জাতি এই অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত এই দেশটির সমতলেও এই মানুষগুলো বসতি স্থাপনের অনেক পরে বাঙালি একটি জাতি হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, বাঙালি জাতির নামকরণ হয়েছে এখন থেকে হাজার বছর আগে। এর আগে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন নামে এ অঞ্চলে বসবাস করত।
বলা হয়, ব্রিটিশরা নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল।
মেসবাহ কামাল বলেন, “আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এমনটা বলা যাবে না। এটা চা শ্রমিকদের বেলায় বলা যেতে পারে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে।”
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনাকে ‘অত্যন্ত অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, "সংবিধানের পরিবর্তন হতেই পারে। এটি কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। তাছাড়া সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি যে, আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। কাজেই এই ধরনের নির্দেশনা দিয়ে তারা একটি গর্হিত কাজ করেছেন।”
আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, “আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশের আদিবাসীরা যে পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করতে চান, সেই পরিচয়ই দেবেন। এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মূলত প্রচারমাধ্যমগুলোকে। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে এইভাবে নির্দেশনা দেওয়া যু্ক্তিযুক্ত বলে মনে করছি না আমি।
“সংবিধান সবাই পড়েছে, সংবিধান সবাই জানে। আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করলে সংবিধানের কোনো অবমাননা হয়, এমনটা মনে করি না।”