কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৭৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার বাদী নিরক্ষর। কিন্তু মামলায় সবার অফিস আইডি নম্বরও দেওয়া। সাবেক আইজিপি নুরুল হুদার চোখে ‘পুরো বিষয়টি তামাশা’।
Published : 13 Dec 2024, 01:24 AM
অক্টোবর মাসে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার পদের এক কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে দেখা হয় একটি মামলার বাদী মোছা. বিথি খাতুনের সঙ্গে।
বিথির স্বামী গাড়িচালক হাফিজুর রহমান সুমনকে ৫ অগাস্ট রাজধানীর শেরেবাংলা নগর মহিলা কলেজের সামনে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ অগাস্ট তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপিসহ ৬৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন বিথি। মামলাটি তদন্ত করছেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই সাব্বির।
তদবিরে বিরক্ত হয়ে সাব্বির তাকে নিয়ে সেই অতিরিক্ত উপকমিশনারের দপ্তরে যান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “বাদী দুই-একদিন পরপর ফোন করে খালি একে গ্রেপ্তার করা যাবে না, তাকে ধরতেই হবে এসব তদবির করেন।”
বিথি বলছেন, তিনি ৬৯ জনকে আসামি করলেও শেখ হাসিনা এবং আরও ৫-৬জনকে ছাড়া কাউকে চেনেন না। বাকিদের আসামি করা হয়েছে স্থানীয় এক নেতার কথায়।
বাদীর কথা শুনে এডিসি বলেন, “আপা এভাবে তো আপনার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার করা কঠিন হয়ে যাবে। আপনি প্লিজ পুলিশকে কাজ করতে দেন। এমনিতেই মামলায় ৬৯ আসামি।”
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা বলছেন, “মামলাটি বাদী বেচে দিয়েছেন মিরপুরের এক বিএনপি নেতার কাছে। মূলত ওই নেতা বাদীকে কিছু টাকা দিয়ে এখন ইচ্ছামত নাড়াচ্ছেন। মামলায় স্থানীয় বিএনপির কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করানোরও তদবির এসেছিল, তবে পুলিশ তা পাশ কাটিয়ে গেছে।”
মামলার বিষয়ে পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষে যোগাযোগ করা হলে বিথি খাতুন বলেন, ‘বেচা-বিক্রির’ বিষয় না। তিনি যেহেতু কাউকে চেনেন না, এ কারণে মামলা করার ক্ষেত্রে পরিচিত একজনের কথা শুনেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে এমন অজস্র মামলা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদনে আসছে, আসামি করার পর তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাদী ‘হলফনামা’ দিয়ে বলছেন, তিনি নির্দোষ।
এসব ঘটনা যে ঘটছে, সে কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার। তিনি মামলা করে যারা টাকা আদায় করছেন, তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা চাঁদাবাজির মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এসব ঢালাও মামলার ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান সুনির্দিষ্ট নয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপি একাধিকবার বলেছেন, মামলা হতে হবে ‘সুনির্দিষ্ট’। আবার যখন মামলা হচ্ছে, তখন মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, অভিযোগ নিয়ে গেলেই তা জমা নিতে।
ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার এক কর্মকর্তা বলেছেন, মামলা না নিলেই বলা হবে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’, এই ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব না।
কেবল থানা নয়, মামলার আবেদন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতেও। গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলার আবেদনে ৫৩ জন সাবেক সচিবের নাম লেখা হয়।
সারাদেশে ‘ভুয়া’ মামলা হচ্ছে এবং মামলা নিয়ে বাণিজ্যও যে চলছে, সে কথা স্বীকার করে আইজিপি বাহারুল আলম সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, “এসব মামলার তদন্তে পুলিশ রেঞ্জওয়ারি মনিটরিং ও মেন্টরিং কমিটি গঠন করছে, এসব কমিটিতে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও যুক্ত করা হবে।”
সরকারের পক্ষ থেকে ‘হয়রানি’ রোধে জেলায় জেলায় কমিটি করার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
এর মধ্যেই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তারের জন্য আবার কাউকে গ্রেপ্তার ‘না করার জন্য’ বাদীপক্ষ থেকে সমানে চাপ আসছে।
“এত চাপ সামলে এই মামলাগুলো সুরাহা করা পুলিশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে,” বলেছেন পুলিশের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা।
এর মধ্যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না, রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। পুলিশ কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশকে বিভিন্ন জায়গা ‘সংযুক্ত’ করে কাজ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে এসব মামলা পুলিশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে বলে তার শঙ্কা।
বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এর নভেম্বরের প্রতিবেদন বলছে, ভুয়া মামলা চলছেই। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তারা প্রতিবেদন তৈরি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “নভেম্বর মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ের ঘটনা নিয়ে ৬১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টিতে আসামি করা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সুনির্দিষ্টভাবে নাম রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৮৫৬ জনের। ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির সংখ্যা কমপক্ষে ৫ হাজার ৫১৭ জন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও আসামিদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিক এমনকি এখন রাজনীতিতে দৃশ্যত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বিএনপির নেতারাও।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামি করা হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে এসেছে।”
‘নিরক্ষর’ বাদী জানেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অফিস আইডিও
সরকার পতন আন্দোলনের সময় সংঘাতের ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় গত ১৩ নভেম্বর করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৭৬ জন কর্মকর্তা, ৬ কর্মচারীসহ ২৬৫ জনকে।
বাদীর অভিযোগ, গত ১৯ জুলাই আসামিরা ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নেওয়া তার গাড়িচালক ছেলেকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছেন।
কৃষি কর্মকর্তারা এই মামলাকে ‘হয়রানিমূলক’ দাবি করে বলছেন, মামলা থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহারে তারা কৃষি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন, তবে স্বস্তিতে নেই কেউ।
মামলায় কৃষি সম্প্রসারণের চলমান ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ২৫টির পরিচালককে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, মামলার পরে তাদেরকে প্রকল্প ছাড়ার চাপ দেওয়া হচ্ছে, এমনকি মামলার আগে কারও কারও কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে।
সচিবের কাছে করা আবেদনে বলা হয়, ‘মিস্টার হোসেন’ নামে একজন মামলাটি করেছেন। এতে তাদের দাপ্তরিক কার্যক্রম ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা হচ্ছেন মানসিক কষ্টের শিকার।
আবেদনে আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভার কার্যবিবরণীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “ওই সভায় বলা হয়েছিল আদালত বা থানায় দায়ের করা মামলায় সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে গ্রেপ্তার না করা এবং মামলার তদন্ত করে কোনো কর্মকর্তা বা ব্যক্তির সম্পৃক্ততার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া না গেলে তাদের নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মামলার একজন আসামি, যিনি অবসরের পর এখন একটি প্রকল্পে কাজ করছেন, তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, “অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রকল্প পরিচালকদের সরিয়ে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের একটি মহল এই কলকাঠি নাড়ছে।”
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান এই মামলার প্রসঙ্গে বলেন, তিনি তদন্ত করা ছাড়া মামলাটি নিতে চাননি। কিন্তু পরে ‘একটি পক্ষ’ থানায় এসে চাপ তৈরি করলে তাকে মামলাটি নিতে হয়।
“তবে মামলাটির তদন্তে কাউকে নিরপরাধ পাওয়া গেলে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করবে পুলিশ। কোনোভাবে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না,” বলেন তিনি।
আসামিরা হয়রানির আশঙ্কায় নাম প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমে কথা বলতে চান না। তবে একজন কর্মকর্তা একটি চিরকুটে কয়েকটি অসামঞ্জস্যের কথা উল্লেখ করে হাতে গুঁজে দেন।
তাতে লেখা, মামলার এজাহারে বাদী লিখেছেন, “আমি লেখাপড়া জানি না। “বর্ণিত ঘটনা আমার কথামত লেখা হয়েছে। আমাকে পড়ে শুনালে আমি টিপসহি প্রদান করিলাম।”
ওই কর্মকর্তার যুক্তি, তিনি লেখাপড়া জানেন না, তাই স্বাক্ষরের বদলে নেওয়া হয়েছে তার টিপ সই। তবে তিনি মামলার ২৬৫ জন আসামির নাম-পরিচয় ঠিকঠাকই দিয়েছেন। কারও স্থায়ী ঠিকানার সঙ্গে বর্তমান ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে।
“কর্মকর্তাদের নাম ঠিকানার পাশাপাশি অফিসের আইডি নম্বরও মামলায় দেওয়া হয়েছে। এটাই এই দপ্তরের কোনো পক্ষের সঙ্গে বাদীর যোগসাজশের শক্ত প্রমাণ,” লেখা হয়েছে ওই চিরকুটে।
মামলায় উল্লিখিত ফোন নম্বরে কয়েকদিন ধরে ‘মিস্টার হোসেনের’ সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
মামলায় তার বর্তমান ঠিকানা লেখা হয়েছে শুধু মোহাম্মদপুরের টিক্কাপাড়া পানির পাম্পের পাশে। সেখানে গিয়েও ওই নামে কারো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বাদীর বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের ভাউলাগঞ্জে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকার বাইরেও একই চিত্র
বগুড়ায় একজন সাংবাদিকের নামে হত্যা মামলা দেওয়ার পর তার এক আত্মীয় বাদীর কাছ থেকে একটি ‘হলফনামা’ নিয়ে এসেছেন, যাতে বলা আছে, “এটা ভুলবশত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, আদালত তাকে অব্যাহতি দিলে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
টাকা দিতে হয়েছে কি না, এই প্রশ্নে সেই সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তা তো দিতে হয়েছেই। তবে আমি দিইনি। আমার আত্মীয় দিয়েছে, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বলেছেন, ‘এটা তোমার জানতে হবে না’।”
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনে কাজ করা এই সংবাদকর্মী বলেন, “বগুড়ায় এমন প্রচুর আসামিকেই এভাবে ‘হলফনামা’ দিচ্ছেন বাদীরা। ২ লাখ থেকে শুরু করে ২০ লাখ টাকাও দিতে হচ্ছে। যার আর্থিক সক্ষমতা যত, তাতে তত বেশি টাকা দিতে হচ্ছে।”
তিনি এও বলেন, মামলা করার পর আসামির বাড়িতে গিয়েও দেনদরবার করছেন বাদীরা। বাদী ও তার সঙ্গে থাকা লোকদেরকে ধাওয়া করার একাধিক ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
‘এদিক গেলেও ঝামেলা, ওদিক গেলেও ঝামেলা’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা মনে করেন, পুলিশ এখানে উভয় সংকটে পড়েছে।
তিনি বলেন, “পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল-পিআরবিতে বলা আছে, কেউ ধর্তব্য অপরাধ সম্পর্কে অভিযোগ করতে এলে পুলিশ আগে সেটি গ্রহণ করবে। এটি সত্যি কী মিথ্যা তা প্রথমে দেখতে যাবে না। এরপরে তদন্ত করে দেখবে এ অভিযোগ ঠিক কি না।
“আবার ফৌজদারি কার্যবিধিকে তদন্তের বিষয়ে বলা আছে, অভিযোগ দেখে যদি (পুলিশ কর্মকর্তার) মনে হয় যে এর মধ্যে কোনো সারবত্তা নেই, বা এটি খুব তুচ্ছ বা সন্দেহ করার অবকাশ আছে তাহলে একটা প্রাথমিক বন্দোবস্ত নিতে পারেন অফিসার। একটা সাধারণ ডায়েরি করে তারপরে সত্যাসত্য দেখে।”
সাবেক আইজিপি বলেন, “এটা এমন একটা অবস্থা, এদিক গেলেও ঝামেলা আবার ওদিক গেলেও ঝামেলা। যদি সে কোনো অ্যাকশন না নেয় তাহলে বাদী বলবে যে, ‘পয়সা খেয়ে’ বা অন্যভাবে প্রভাবিত হয়ে পুলিশ আসামি ধরছে না বা কাজ করছে না। আবার এর উল্টোদিকও আছে। তবে এফআইআরে নাম থাকলেই ধরতে হবে এ কথা কোথাও বলা নেই।”
মোহাম্মদপুর থানায় কৃষি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলাটির বিবরণ বলা হলে নুরুল হুদা বলেন, “মামলা মোহাম্মদপুরে, আসামি অ্যাগ্রিকালচার এক্সটেনশন, পঞ্চগড়ের বাদী… পুরো একটা তামাশা। নিশ্চয় কারও উদ্দেশ্য আছে একটা।
“একজন পড়াশোনা না জানা ব্যক্তি এভাবে অভিযোগ করে কীভাবে? তার সক্ষমতা কী? বাদীকে ধরা উচিত।”
এসব ক্ষেত্রে পুলিশ আসলে কী করবে- এই প্রশ্নে সাবেক আইজিপি বলেন, “থানা পুলিশের চার্জে থাকা অফিসার থেকে শুরু করে তার ওপরেও দুই-তিন স্তরের যে তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তা আছেন বা আরও উচ্চতর পর্যায়ে, পুলিশ হেডকোয়ার্টারসহ যতগুলো পর্যায়ে আছে তাদেরকে বিষয়টা জানাতে হবে। একেবারে সব শেষে মিনিস্ট্রি অব হোম যেখানে পলিটিক্যাল লোকজন থাকে এ সব জায়গায় বলতে হবে।”
সতর্ক করছেন পুলিশের শীর্ষ কর্তারাই
সরকার পতনের পর প্রথম দিকে সব মামলা নিতে সরকারের তরফে নির্দেশ এলেও চার মাস পরে এসে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বহু মামলার বাদীর কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়ে যেসব কথা বলেছেন, তাতে মামলা করে বাদীর টাকা আদায়, আসামি গ্রেপ্তার বা গ্রেপ্তার ‘না করার’ বিষয়ে চাপের যে অভিযোগগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো যে ‘সত্য’, তা ফুটে উঠেছে।
গত ৮ ডিসেম্বর নিজের দপ্তরে অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্র্যাবের সদস্যদের সঙ্গে মত বিনিময়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “বাদী মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে প্রমাণ না পেলে নাম বাদ দেবেন।”
তিনি বলেন, “অনেক বাদী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা করেছেন পরিকল্পিতভাবে ‘বাণিজ্য করতে’। এজন্য ১৫০-২০০ বা আরও বেশি আসামি করা হয়েছে। প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা বা বিগত সরকারের শীর্ষ নেতাদের নাম দিয়ে পরে ঢালাওভাবে ইচ্ছেমত নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশকে মামলা নিতে বাধ্য করা হয়েছে।”
এসব ঘটনায় পুলিশের অনেক কর্মকর্তা জড়িয়ে গেছেন, এমন কথা বলেছেন স্বয়ং ডিএমপি কমিশনার।
তারও তিন দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে আইজিপি বাহারুল আলম বলছেন, “এসব মামলাকে কেন্দ্র করে অনেকে বাণিজ্য করছে, তারাও প্রভাবশালী লোক। নিরীহ লোকদের আসামি করা হয়েছে, তাদের নানা প্রলোভন দেখাচ্ছেন, প্রতারিত করছেন, টাকা নিচ্ছেন।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের প্রতি এখন সাধারণ নির্দেশনা হচ্ছে ‘দেখে-শুনে’ মামলা নেওয়া। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা মামলা না নেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
মোহাম্মদপুর থানার একজন এসআই বলছেন, “আমরা তো দেইখাই বুঝি কোনটা ভুয়া মামলা। কিন্তু মামলা না নিতে চাইলে ওরা বলে ‘পুলিশ হাসিনার দোসর’। এ কারণে যারাই মামলা করতে আসে আমরা কেউ কিছু কই না।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ২৪ নভেম্বর সচিবালয়ে বলেছেন, “ভুয়া ও মিথ্যা মামলা হচ্ছে– এটা আমি অস্বীকার করব না। ভুয়া ও মিথ্যা মামলা যেন না হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি। এই ধরনের মামলা যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা বড় ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।”
তারও আগে গত ১২ নভেম্বর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “সাধারণ লোকজন, ভুক্তভোগী লোকজন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারা অন্যদের ব্যাপারে ঢালাও মামলা দিচ্ছে। ঢালাও মামলার একটা মারাত্মক প্রকোপ দেশে দেখা দিয়েছে, এটা আমাদেরকে অত্যন্ত বিব্রত করে।”
এই ধরনের কথা সরকারের তরফে একাধিকবার বলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন
ঢালাও আসামি করে 'বাণিজ্য', হবে পাল্টা চাঁদাবাজির মামলা: ডিএমপি
নিরপরাধ মানুষকে মামলায় হয়রানি না করার অনুরোধ ছাত্র আন্দোলনের
ঢালাও মামলায় সরকার 'বিব্রত': আইন উপদেষ্টা
আন্দোলনের ঘটনার মামলা তদন্তে যুক্ত হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্তরা: আইজিপি
ট্রাইব্যুনালে আরেক অভিযোগ, ৫৩ আসামির মধ্যে ২৯ সাংবাদিক
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও হত্যা মামলায় 'দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন'