“একশর কম সাক্ষ্য নেওয়া ঠিক হবে না, মামলা প্রমাণ করা যাবে না,” বলছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
Published : 24 Apr 2024, 01:18 AM
এগার বছর আগের সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
এখন রাষ্ট্রপক্ষের ৮৪তম সাক্ষী থ্রিপিস বিক্রেতা খলিলুর রহমানের সাক্ষ্য চলছে। রানা প্লাজার দ্বিতীয় তলার এ দোকানি গত রোববার সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী ২৮ এপ্রিল তার আরও সাক্ষ্য নেওয়ার কথা। তিনি রানা প্লাজা মাকের্টের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আটতলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজারখানেক তৈরি পোশাক শ্রমিককে।
বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া সেই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলা উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর ২০২২ সালে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। তবে ইমারত বিধি না মেনে ভবন তৈরির মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের পরপর বেশ কয়েকটি মামলা হলেও এ দুটিই মূল মামলা। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলে বেশির ভাগ আসামি জামিনে বা পলাতক রয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলছেন, “মামলার ৪১ আসামির মধ্যে চারজন জামিন পেয়ে গেছেন, কিন্তু সোহেল রানা জামিন পচ্ছেন না। অথচ রানা প্লাজার জমির মালিক তার বাবা-মা, যা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি দুঃজনক।”
রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যা মামলাটির বিচারে এখন খানিকটা গতি এসেছে। মাসে দুইবার করে সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে।
মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হেলাল উদ্দিনের আদালতে।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে তিন ধরনের সাক্ষী আছে, যাদের মধ্যে এক ধরন হচ্ছে ঘটনার ভূক্তভোগী আহত শ্রমিক। আরেক ধরনের সাক্ষী হলেন- নিহতদের স্বজন, যারা লাশ উদ্ধার করেছিলেন। এর বাইরে সাক্ষী আছেন পুলিশ সদস্যরা, যারা বিভিন্নভাবে মামলার আলামত জব্দ, তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য প্রত্যেকে এক হাজার টাকা রাহা (যাতায়াত ও দুপুরের খাবার) খরচ দেওয়া হয় ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইডের তহবিল থেকে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমাদ্দর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একশর কম সাক্ষ্য নেওয়া ঠিক হবে না। মামলা প্রমাণ করা যাবে না।”
বিচার ‘তাড়াতাড়ি’ শেষের আশা
হত্যা মামলার মূল আসামি সোহেল রানা গত বছরের ৬ এপ্রিল হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগ সেই জামিন স্থগিত করে দেওয়ায় তিনি মুক্তি পাননি।
রানা প্লাজা ধসের পাঁচদিন পর ২৯ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে সোহেল রানাকে যশোরের বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
মামলা দায়েরের দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।
এর একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে আসামি করা হয়। আর ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে অপর অভিযোগপত্রে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়।
দুই অভিযোগপত্রে মোট আসামি ছিলেন ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। আসামিদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলার সাক্ষী ৫৯৪ জন হলেও সবার সাক্ষ্য গ্রহণের দরকার হবে না। যেভাবে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে তাতে বিচার তাড়াতাড়ি শেষ হবে বলে আশা করছি সবাই।
“তবে যেভাবে সাক্ষী আসার কথা ছিল, সেভাবে কিন্তু আসছে না। অথচ গত ১৫ জানুয়ারি আপিল বিভাগ নির্দেশ দিয়েছিলেন ৬ মাসের মধ্যে মামলাটির বিচার শেষ করতে।”
হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণে গতি
ঢাকার জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এবং রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত কৌঁসুলি বিমল সমাদ্দরের উদ্যোগে এ মামলা গতি ফিরে পায়।
এর আগে অভিযোগ উঠেছিল, কয়েকজন আসামির আবেদনে উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া স্থগিতাদেশের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে জজ আদালতে আসছে না, দিনের পর দিন তা পড়ে থাকছে।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে হত্যা মামলার বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন।
এ মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবন মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কলু খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন এরইমধ্যে মারা গেছেন।
অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন মামলা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। তাদের আবেদনে হাই কোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করে।
উচ্চ আদালতের ওই স্থগিতাদেশে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। পরে মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্য আসামিদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়।
অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
ইমারত বিধির মামলার জট খুলবে কবে?
রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় মামলা করেন।
২০১৫ সালের ১ জুন সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। এরপর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৬ সালের ১৪ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ এবং সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে।
রানা প্লাজা ধস: মামলা বিচারে গতি
অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফায়েত উল্লাহার আবেদনে তার ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় হাই কোর্ট। ফলে দীর্ঘদিনেও এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি বলে জানান ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি শেখ হেমায়েত হোসেন।
তিনি বলেন, “অভিযোগ গঠনের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে গিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা মামলাটি স্থগিত করেছেন। আমি অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কথা বলেছি। এটা ভ্যাকেট করার উদ্যোগ নিতে হবে।”
দুদকের দুই মামলায় রায়
রানা প্লাজা ধসের পর সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের পর তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে তিনটি মামলা করে দুদক। যার মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। ওই মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আদালত।
এছাড়া ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা রয়েছে।