‘কডি মুবাইল’ চালানো নাসিরনগরের রসরাজের নিস্তার কবে?

হামলার মামলার রায় হয়েছে, তবে মামলার জালে এখনও ফেঁসে আছেন নাসিরনগরের এই জেলে।

ওয়াসেক বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2023, 07:44 PM
Updated : 16 March 2023, 07:44 PM

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যার নামে খোলা ফেইসবুকে অ্যাকাউন্টে উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালানো হয়েছিল, সেই রসরাজ দাসের নিস্তার মেলেনি এখনও।

দেশজুড়ে আলোচিত এই সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় করা আটটি মামলার মধ্যে সাড়ে ছয় বছর পর বৃহস্পতিবার প্রথমটির রায়ে ১৩ জনের চার মাস করে কারাদণ্ড হয়েছে।

কিন্তু রসরাজকে শাস্তি থেকে বাঁচতে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে এখনও। তার বিরুদ্ধে যে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ, সেটি আসলে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল শুরু থেকেই।

মাছ ধরে জীবন চালানো মানুষটি স্মার্টফোনই চালাতে জানেন না। এখনও নিজের হাতে থাকা মোবাইল ফোনটিকে ‘কডি মুবাইল’ বলেন তিনি।

‘রসরাজ দাস’ নামে ফেইসবুক আইডিতে থাকা ধর্ম অবমাননাকর ছবি দেখিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির ও অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।

এই সহিংসতার পরে রসরাজকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ, তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দিয়ে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছিল। পরে জানা যায়, তিনি একজন জেলে, যার অক্ষরজ্ঞান নেই, স্মার্টফোনও চালাতে পারেন না।

আর হামলার ঘটনায় স্থানীয় বারোয়ারি মন্দিরের পুরোহিতসহ দুই ব্যক্তি দুটি মামলা করেন। প্রত্যেকটি মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১০০০ থেকে ১২০০ জনকে আসামি করা হয়। পরে পুলিশও কিছু মামলা করে।

এই ঘটনায় সে সময় যে আটটি মামলা করা হয়, তার মধ্যে রায় এসেছে উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়া এলাকার পুরাতন দুর্গামন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়।

Also Read: নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস: প্রথম রায়ে ১৩ জনের কারাদণ্ড

মামলাটি করেন নাসিরনগর থানার তৎকালীন এসআই সাধন কান্তি চৌধুরী। দীর্ঘ তদন্তের পর ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়েছিল। তাদের সবারই সাজা হল।

এই রায়ের খবর জেনেছেন রসরাজ। এর প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অন্যায় করছে, অন্যায়ের বিচার অইছে, আমরা খুশি। এইভাবে যদি আমার মামলাডা শেষ হয়া যাইত, যদি আমি মুক্তি পাইতাম!”

বছরের পর বছর এই মামলাটি চলার কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত তিনি। বলেন, “আমি গরিব মানুষ নদীত মাছ ধইরা খাই। হাজিরা দিতে দিতে আর ভালা লাগতাছে না। হাজিরা দিতে দিন দিন কাম বন্ধ। ফ্যামিলি চালানো কষ্ট হয়া যাইতাছে।”

এগুলো আদালতে বলেননি?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার উকিলরে কইছি। কোর্টে জজ স্যারে যদি ডাক না দেয়, তারে কইমু কীভাবে?”

হাজিরার দিন থাকেন না?- জানতে চাইলে রসরাজ বলেন, “থাহি, কিন্তু জজ স্যারে ডেইট ফালায়া দেয় খালি।”

রসরাজকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এখন মামলার হাজিরা দিতে ছুটতে হয় চট্টগ্রামে।

তার কারণ জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার হয়ে আইনি লড়াই করা আইনজীবী মো. নাসির বলেন, পুলিশ প্রতিবেদন দেওয়ার পর মামলাটি চট্টগ্রামে সাইবার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হয়েছে।

সেখানে রসরাজের পক্ষে একজন আইনজীবীও ঠিক করে দিয়েছেন তিনি।

‘কডি মুবাইল’ থেকে ফেইসবুকে পোস্ট কীভাবে?

সহিংসতার পরে রসরাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “ফেইসবুক কী জিনিস, তা-ই আমি জানতাম না। অথচ ঘটনার দিন আমাকে একদল লোক মারতে মারতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। আমি গুরুতর আহত হই। পরে তারা আমাকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়।”

এরই মধ্যে নাসিরনগরের ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তকারীরা জানতে পারেন, রসরাজের মোবাইল ফোন থেকে ধর্মীয় অবমাননার ছবি আপলোড হয়নি। ওই ছবি সম্পাদনা করা হয়েছিল হরিণবেড় বাজারে আল আমিন সাইবার পয়েন্ট অ্যান্ড স্টুডিও থেকে, যার মালিক জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি।

ঘটনার শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল, জাহাঙ্গীর আলম তার সাইবার ক্যাফে থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটি প্রিন্ট করে লিফলেট আকারে তা এলাকায় বিতরণ করেন।

গত বছরের ২৮ নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তা স্বীকারও করেন।

এই বিষয়গুলো সামনে আসার পর রসরাজ আসলে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার মতো ‘যোগ্যতা’ রাখেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।

তারপরও পুলিশ তাকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দেয় বলে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার হয়ে আইনি লড়াই চালানো মো. নাসির।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই আইনজীবী বলেন, “আসলে কী বলব, রসরাজের বিরুদ্ধে বলার মতো কোনো প্রমাণ নেই। তবে বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করতে পারি না।”

Also Read: আড়াই মাস পর কারামুক্ত রসরাজ

পুলিশ প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “পিবিআই ও সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রসরাজ সেই পোস্ট দিয়েছেন, তার প্রমাণ মেলেনি।”

নাসিরনগর থানার তৎকালীন এসআই মহিউদ্দিন সুমনের সেই মামলায় পুলিশ তাহলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন না দিয়ে অভিযোগপত্র কেন দিল?

নাসির বলেন, “রিপোর্টে বলেছে, রসরাজের ক্ষমা চাওয়ার পোস্ট আছে। আদালতের নথিতে আছে সাক্ষী আশুতোষ দাস ১৬১ ধারায় বলেছেন, তিনি এটি দিয়েছেন। তাই পুলিশ বলেছে, রসরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে।”

এই কথাগুলো অভিযোগ গঠনের সময় বলেননি কেন- এমন প্রশ্নে নাসির বলেন, “সেই শুনানিতে আমি থাকতে পারিনি। তখন আইনজীবী কী করেছেন, তা জানি না।”

প্রতিবেদন দেওয়ার আগে কেন বলেননি?- এমন প্রশ্নে জবাব এল, “ওই পুলিশ প্রতিবেদন আসার আগে চলত জুডিশিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সেই কোর্টের আসলে এখতিয়ার ছিল না। এখন এখতিয়ার আছে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে। তারা দেখবে।”

চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে রসরাজের পক্ষে লড়াই করা আইনজীবী ভুলন ভৌমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এখনও অভিযোগ গঠন হয়নি। হবে কি না, তার শুনানি চলছে।

যে লোকটার অক্ষরজ্ঞান নেই, তিনি ফেইসবুকে কীভাবে পোস্ট দিলেন, এই বিষয়টি বিচারককে বলেননি?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা জজ সাহেবকে বললাম, যে লোক পড়ালেখা জানে না, তাকে যদি চার্জ করেন, তাহলে বিষয়টা কী হল? বিচারক বললেন, ‘সাক্ষী আসুক, দেখা যাক’।”

স্বল্প আয়ের একজন মানুষের পক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াতের যে আর্থিক চাপ, এই বিষয়ে এই আইনজীবী বলেন, “আমাদের যতটুকু ক্যাপাসিটি আছে করছি। আপনারাও একটু দেখুন। কোনো মানবাধিকার সংগঠনকে দিয়ে মামলাটি ঢাকায় কোয়াশ করে দেওয়া যায় কি না, তাহলে তো তিনি (রসরাজ) বাঁচলেন।”

বিচারিক আদালতে কোনো ফৌজদারি মামলা চলার যে কোনো পর্যায়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করে সেটিকে স্থগিত বা বাতিল করার সুযোগ আছে। আইনি পরিভাষায় একে বলে ‘কোয়াশ’।

২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর রসরাজের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। পরের দিন তা পাঠানো হয় চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে।

তবে প্রতিবেদনে বলা হয় রসরাজের মোবাইল ফোন ও মেমোরি কার্ডের ফরেনসিক প্রতিবেদনে তার আইডি থেকে পোস্ট দেওয়ার কোনো আলামত মেলেনি।

তারপরও রসরাজকে অভিযুক্ত করার পেছনে কারণ বিষয়ে ইকবাল হোসেন তখন গণমাধ্যমকে বলেন, “রসরাজ পোস্ট দেওয়ার পর ক্ষমা চেয়ে সেটা ডিলিট করে দিয়েছে- এমন পোস্টের অস্তিত্ব পেয়েছে ফরেনসিক বিভাগ। ফরেনসিকের সব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে, সব ডিভাইস পরীক্ষা করে, বিশেষজ্ঞদের মতামত, সাক্ষ্য–প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক সবকিছুর ভিত্তিতে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।”

মামলা কী নিয়ে, এখনও ধারণা নেই রসরাজের

মামলাটি কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চট্টগ্রামে গেল, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে, এসব প্রশ্নে রসরাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযোগ কী তা তো জানি না। আমার উহিলে কইতে পারব।”

তিনি শুধু জানেন, ‘মামলা আগে আছিন বাউনবাইরা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), এহন গেছে চট্টগ্রাম’।

আদালতে কী কথা হয়, না হয়, সে বিষয়েও ধারণা নেই তার। বিচারক কী বলেন, এমন প্রশ্নে রসরাজ বলেন, “কিছু তো কয় না, ডেইট দেয় খালি। মন চাইলে ডাহে।

শেষবার কবে গেছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সামনের মাসের (ফেব্রুয়ারির) ১৪ তারিখ গেছিলাম।”

তার মত স্বল্প আয়ের একজন মানুষের পক্ষে দূরের জেলায় ভ্রমণ করা কতটা চাপ, সেই বিষয়টিও উঠে এল কথোপকথন।

রসরাজ মাছ ধরার কাজ করেন। তবে এখন পাওয়া যায় না খুব একটা। তিনি বলেন, “আগে তো নদীত ধরতাম। নদীত অহন মাছ নাই। শুকায়া গেছে। পুকুরে ধরি।”

“এক রাইত মাছ ধরলে ৩০০ টাকা রুজ রাহি।”

এই আয়ে সংসার চলে?- এমন প্রশ্নে জবাব এল, “কোনো রকমে আছি আরকি। মাছ না ধরলে বাইত থাকতে অয়।”

আদালতে যাওয়া আসায় কতটা হ্যাপা- সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কোর্টে যাওয়া আসায় কষ্ট অইতাছে। ৪/৫ হাজার খরচ অয়া যায়।

“বাউনবাইরার উহিল তো পয়সা নিত না। চট্টগ্রামের উহিলে পয়লা পয়লা পয়সা নিত। অহন নেয় না। নির্মুল কমিটির শাহরিয়ার কবির স্যারকে একদিন ফোন কইরা কইছি। এরপর স্যারে কইয়া দিছে। পরেত্তে আর টাকা পয়সা নেয় না।

“কিন্তু যাইতে একদিন, আইতে একদিন থাকতে একদিন। তিন দিনের মামলা।”

স্মার্টফোন, ফেইসবুক চেনেন? এমন প্রশ্নে দুইবারই জবাব এল, ‘না’।

আপনার কী ফোন?- রসরাজ বললেন, “কডি মুবাইল।”