ষষ্ঠ-সপ্তমের পাঠ্যবইয়ে কী সংশোধন আসছে

অনুসন্ধানী পাঠ পুরোপুরিই বাদ যাবে; অনুশীলন বইও কিছু কিছু জায়গায় সংশোধন হবে।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2023, 08:59 AM
Updated : 11 Feb 2023, 08:59 AM

পাঠ্যপুস্তকের ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনার মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার ছাড়াও আরও তিনটি বইয়ের কিছু অধ্যায় সংশোধনের কথা জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি।

বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বইগুলো সংশোধন করে দেখবে প্রতিষ্ঠানটি; এক্ষেত্রে সংশোধনী বেশি হলে গোটা বই পাল্টে দেওয়ার কথা বলছেন সংস্থার চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সিদ্ধান্তটি গতকালই আমাদের সব উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। তারা নতুন এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল আছেন।

“দুটি বই তো প্রত্যাহার হচ্ছে। আর যেসব বই সংশোধন হবে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছি।”

পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, “তাদের (বিশেষজ্ঞ) মতামত অনুযায়ী বইগুলো সংশোধন হলে আমরা দেখবে এর আকার কেমন হচ্ছে। সংশোধনী খুব ছোট হলে আমরা তা স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেব। আর বেশি সংশোধনী আসলে আমরা পুরো বই পাল্টে দেব।”

এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় কত সময় লাগতে পারে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “লেটস সি। বিশেষজ্ঞরা দেখবেন। আশা করছি দ্রুতই হবে।”

অনুসন্ধানী পাঠ পড়ানোই হবে না

শুক্রবার এনসিটিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি পাঠদান হতে প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়।

এই প্রত্যাহার আর সংশোধন কেন এবং কোন অধ্যায়গুলোতে সংশোধন আসতে পারে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানের কাছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন কারিকুলামে সিক্সে এবং সেভেনে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের দুটি অংশ; একটি অনুশীলন বই, আরেকটি অনুসন্ধানী পাঠ। আমরা দুই শ্রেণির অনুসন্ধানী পাঠ অংশটি প্রত্যাহারের কথা বলেছি।”

আগে এই বিষয়ের একটি বই থাকলেও এখন দুটি বই। অধ্যাপক মশিউজ্জামানের মতে, অনুসন্ধানী পাঠ বাদ দিলেও শিক্ষার্থীদের পড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে না।

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা মূলত যে বইটিকে তাদের মূল পাঠ্য হিসেবে পড়বে, সেটি হচ্ছে তার অনুশীলন বই, এই অংশে শুধু সংশোধন হবে, প্রত্যাহার নয়। উঠে যাচ্ছে শুধু অনুসন্ধানী পাঠ। এই বই মূলত শিক্ষার্থীরা অনুশীলন বইয়ে যা পড়বে, তার সাথে যেন নিজেদের চিন্তাকে মেলাতে পারে তার জন্য করা হয়েছিল।

“আমাদের সব শিক্ষার্থীর হাতে তো ইন্টারনেট নেই যে তারা খুঁজে দেখে নেবে। সবাই যেন পড়ার পাশাপাশি বাস্তবতা নিয়ে জানতে পারে তার জন্য অনুসন্ধানী পাঠের বইটি করা হয়েছিল।”

অনুসন্ধানী পাঠ প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের অনুশীলন বইয়ে আমরা নানা বিশ্বের নানা সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরেছি। এসব ইতিহাসকে প্রদর্শন করতে গিয়ে অনুসন্ধানী পাঠে মিশরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতাগুলো এসেছে, প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে কথা এসেছে, তাদের সংস্কৃতির নানা ছবি ব্যবহার হয়েছে। পরে দেখা গেছে এসব নিয়ে কথা হচ্ছে বেশি, আপত্তি এসেছে তাই আমরা দুই শ্রেণিতে বই দুইটি প্রত্যাহার করেছি।”

প্রত্যাহারের ফলে অনুসন্ধানী পাঠ বইটি পড়ার সুযোগ না থাকলেও অনুশীলনী পাঠ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবে জানিয়ে মশিউজ্জামান বলেন, “এবার বইগুলো অ্যাকটিভিটি বেইজড। আমাদের পাঠ্যবইয়ে যে কন্টেন্ট আছে, তা কিন্তু সব নয়। এর বাইরেও পড়ার সুযোগ শিক্ষার্থীদের আছে। ফলে দুটি বই স্থগিত করলেও শিক্ষার্থীদের পড়ার ক্ষেত্রে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।”

অনুশীলনে সংশোধন

এনসিটিবির বিজ্ঞপ্তিতে ওই দুই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলন বই’য়ের কয়েকটি অধ্যায়ের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে বলে জানানো হয়েছিল।

অনুশীলন পাঠের সংশোধন প্রসঙ্গে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, “ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারতর্ষ দখল করেছেন, নাকি বিজয় করেছেন- এমন কিছু বিষয় নিয়েও আলোচনা আছে। প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে বেশি কথা বলা হচ্ছে, আমাদের ইতিহাসটা কম।

“আমরা এগুলো নিয়ে, বইগুলো যারা তৈরি করেছেন, বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তাদের সাথে বসব; বসে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে সেগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেব।”

সংশ্লিষ্ট অধ্যায়গুলোর সংশোধন না আসা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অন্য অধ্যায়গুলো পড়ানো চলবে বলে জানান তিনি।

এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে জরুরি বৈঠক করে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ নামে দুটি বই পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়। ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ্যবইয়ে ১১তম অধ্যায়ে ‘মানব শরীর’ শিরোনাম অংশে কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধিকালে তাদের শরীরের নানা অঙ্গের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে; যা ‘প্রকাশ্যে পড়ার উপযোগী নয়’ এমন অভিযোগ ওঠায় এ অংশ বাদ কিংবা সংশোধন আসতে পারে।

এছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৯৫ পৃষ্ঠাতে বাংলায় প্রায় ৬০০ বছরের মুসলিম শাসন, সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে সুলতানি শাসন নিয়ে যা লেখা হয়েছে, সেখানেও পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ষষ্ঠ শেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুশীলন বইয়ে ১৩ নম্বর পৃষ্ঠাতে মানুষের পূর্বপুরুষক্রম নিয়ে আলোচনা, সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৫১ ও ৫২ পৃষ্ঠাতে ট্রান্সজেন্ডার বিষয় নিয়ে আলোচনা বাদ বা কিংবা সংশোধন হতে পারে।

তবে কী ধরনের কথা বা আলোচনার ‘চাপে’ বই প্রত্যাহার ও সংশোধনের সিদ্ধান্ত- জানতে চাইলে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, “আনুষ্ঠানিক কোনো পর্যায় না, বইগুলো নিয়ে সারাদেশে সামগ্রিক যে আলোচনা চলছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন ছবি ও দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে বই প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই দুই বই নিয়েই বেশি সমালোচনা ও আপত্তি উঠেছিল।”

Also Read: সপ্তমের বিজ্ঞান বইয়ে হুবহু অনুবাদের দায় স্বীকার জাফর ইকবাল ও হাসিনা খানের

Also Read: বইয়ে অধিকাংশ ভুল ১০ বছর আগের: শিক্ষামন্ত্রী 

Also Read: নতুন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ‘ব্যক্তিগত’ আক্রমণ করা হচ্ছে: দীপু মনি

Also Read: ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুই বই প্রত্যাহার

পরীক্ষা ও মুখস্ত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতেই এ বছর থেকেই নতুন শিক্ষাক্রমে যাওয়ার কথা বলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নতুন বছরে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার পরই বইয়ের পাঠ্য বিষয় নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক বই নিয়ে একটি ‘চিহ্নিত গোষ্ঠী’ অপপ্রচারে নেমেছে। এসব পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে যেসব লেখক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ-বিশেষজ্ঞরা জড়িত, তাদেরকে ‘কদর্য ভাষায়, কুৎসিতভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে এবং হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য ছাপানো পাঠ্যপুস্তকের ভুল সংশোধনে এবং কেন ভুল হল তা তদন্তে ইতোমধ্যে দুই কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের অসঙ্গতি, ভুল বা ত্রুটি চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক আব্দুল হালিমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মাধ্যমিক) মো. আজিজ উদ্দিন।