এবারে ঈদের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় এবং ঘারমুখো মানুষের যাতায়াত ‘স্বস্তিদায়ক’ হওয়ায় গেলবারের তুলনায় এবারে সড়কে হতাহতের সংখ্যা কমেছে।
Published : 09 Apr 2025, 01:44 PM
রোজার ঈদের আগে ও পরে মিলিয়ে ১৫ দিনে দেশে ৩১৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৮২৬ জন।
আর সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে ৩৪০টি দুর্ঘটনায় ৩৫২ জন নিহত এবং ৮৩৫ জন আহত হয়েছেন বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
এ সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের রোজার ঈদের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে ২১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং আহত কমেছে ৪০ দশমিক ৪১ শতাংশ। আগের বছরের ঈদুল ফিতরে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জনের প্রাণহানি হয়েছিল এবং ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছিলেন।
এবারে ঈদের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় এবং ঘারমুখো মানুষের যাতায়াত ধাপে ধাপে ও ‘স্বস্তিদায়ক’ হওয়ার কারণে গেলবারের তুলনায় এবারে সড়কে হতাহতের সংখ্যা কমে এসেছে বলে তাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে এই সংগঠনটি।
তাই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার একগুচ্ছ সুপারিশে তারা ঈদের ছুটি বাড়ানোর বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বুধবার ঢাকার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ঈদযাত্রা শুরুর প্রথম দিন ২৪ মার্চ থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার দিন ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনেন দুর্ঘটনার তথ্য এসেছে এ প্রতিবেদনে। বরাবরের মতই সংবাদমাধ্যমে আসা দুর্ঘটনার খবর সঙ্কলিত করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, রেলপথে ২১টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন ৮ জন। নৌ-পথে ৪টি দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত, ১ জন আহত ও ১ জন নিখোঁজ থাকার তথ্য দিয়েছে সংগঠনটি।
এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরাবরের মত এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৩৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫১ জন নিহত ও ১৫৫ জন আহত হয়েছে। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪২.৮৫ শতাংশ, নিহতের ৪৬.৮৯ শতাংশ এবং আহতের প্রায় ১৮.৭৬ শতাংশ।
ঈদের সড়কে এবার মোটরসাইকেল চলাচলে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। বিপুল সংখ্যক মানুষ এবার মোটরসাইকেলে করে ঢাকা থেকে বাড়ি গেছেন।
এবার ঈদযাত্রায় সড়কে দুর্ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে ৭০ জন চালক, ৪৭ জন পরিবহন শ্রমিক, ৫০ জন পথচারী, ৬০ জন নারী, ৪০ জন শিশু, ৩৩ জন শিক্ষার্থী, ২০ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৬ জন শিক্ষক, ৪ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, এক জন সাংবাদিকের পরিচয় মিলেছে বলে জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
যেসব বাহন দুর্ঘটনায় পড়েছে,সেগুলোর ৩২.২৭ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬.৫৬ শতাংশ বাস, ১৪.৮৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১৪.৪৩ শতাংশ ট্রাক-কভার্ডভ্যান, ৮.০৬ শতাংশ কার-মাইক্রোবাস, ৭.২১ শতাংশ নছিমন-করিমন ও ৬.৫৮ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা।
এসব দুর্ঘটনার ২৭.৩০ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪২.২২ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনা, ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১.৫৮ শতাংশ ট্রেন-যানবাহনে, ০.৩১ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে হয়েছে। এছাড়া ৮.৫৭ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে হয়েছে।
ঈদের আগে ২৭ মার্চ বৃহস্পতিবার ছিল শেষ কর্মদিবস। পরদিন শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি দিয়ে শুরু হয় টানা নয় দিনের সরকারি ছুটি।
এর মধ্যে ৩১ মার্চ সোমবার দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। তার আগের দুদিন এবং পরের দুদিনও ছুটি ছিল। পরে ৩ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে ছুটি ঘোষণা হলে শুক্র-শনি মিলিয়ে এবার ঈদের টানা নয় দিনের ছুটি মিলে যায়।
ঈদযাত্রা ‘স্বস্তিদায়ক’ হওয়ায় ‘দুর্ঘটনা ও হতাহত কমেছে’
সংবাদ সম্মেলন মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “প্রতিবছর ঈদ কেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানীর বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
“তবে এবার দীর্ঘ ছুটির কারণে ধাপে ধাপে বাড়ি ফেরার সুযোগ হওয়ায় ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে সংগঠনের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।”
তিনি বলেছেন,পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে দেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ‘আগের তুলনায় ভালো থাকায়’, সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রকসংস্থা বিআরটিএ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, হাইওয়ে পুলিশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছিল ‘যাত্রীবান্ধব ও দৃশ্যমান’।
“যাত্রীসাধারণ অসংগঠিত ও সচেতন না হওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও পথে পথে যাত্রী হয়রানি চরমে পৌঁছেছিল। গণপরিবহনগুলোতে ঈদকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের কারণে বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে, খোলা ট্রাকে, পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দরিদ্র লোকজনদের ঈদে বাড়ি যেতে হয়েছে।”
দুর্ঘটনার কারণ কি কি
বাংলাদেশে দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
১. দেশের সড়ক মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার অবাধ চলাচল।
২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো।
৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকায় নতুন চালকরা এসব সড়কে দুর্ঘটনায় পড়েন।
৪. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।
৫. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাদাঁবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন।
৬. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, বেপরোয়া যানবাহন চালানো এবং একজন চালকের দীর্ঘসময় ধরে যান চালানো।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির সুপারিশ
১.মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা।
২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।
৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান ।
৪. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
৫. সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা।
৬. সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা। মহাসড়কে ফুটপাত ও পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা রাখা।
৭. সড়ক পরিবহন আইন যথাযতভাবে বাস্তবায়ন করা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা।
৮. উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওর্য়াক গড়ে তোলা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৯.মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা
১০. মেয়াদোর্ত্তীন গণপরিবহন ও দীর্ঘদিন যাবৎ ফিটনেসহীন যানবাহন স্ক্যাপ করার উদ্যোগ নেওয়া এবং ঈদের ছুটি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া।