সব মিলিয়ে ১৬৫ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে ছয় মামলায়।
Published : 12 Dec 2024, 09:42 PM
মোহাম্মদ আবদুল মোমেন নেতৃত্বাধীন নতুন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়িত্বের প্রথম দিনে সাবেক তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক, সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগে।
তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আরো তিনটি মামলা করেছে দুদক। জাহিদ মালিকের ছেলে রাহাত মালেক, জুনাইদ হোসেন পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন এবং মির্জা আজমের স্ত্রী দেওয়ান আলেয়া এসব মামলার আসামি।
সব মিলিয়ে ১৬৫ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে এই ছয় মামলায়।
সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে চেয়ারম্যান করে মঙ্গলবার নতুন কমিশন গঠন করে দেয় সরকার। মোমেনের সঙ্গে এ কমিশনে কমিশনার হিসেবে আছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহ্সান ফরিদ।
দায়িত্ব পাওয়ার পরদিন বুধবার দুদকে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক অফিস করেন চেয়ারম্যান এবং এক কমিশনার। বৃহস্পতিবার প্রথম কমিশন সভায় বসে তারা সাবেক তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমোদন দেন। পরে মামলা দায়েরের আনুষ্ঠানিকতাও সেরে ফেলা হয়।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের বিরুদ্ধে ৬১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, তার ছেলে রাহাত মালেকের বিরুদ্ধে ১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকার ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগে দুটি মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক মো. ফজলুল হক।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ ও তার স্ত্রী আরিফা জেসমিনের বিরুদ্ধে মামলায় আনা হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।
আর সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজম ও তার স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার বিরুদ্ধে দুই মামলায় ৭২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদে অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দেশ বিদেশে তাদের আরও সম্পদ রয়েছে কিনা মামলার তদন্তকালে তা খতিয়ে দেখা হবে।”
জাহিদ মালিকের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তিনি নিজ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ৩৪টি ব্যাংক হিসাব খুলে ১৪৩ কোটি ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৬৯৭ টাকা জমা এবং ১১৫ কোটি ৮৫ লাখ ৬ হাজার ৪৬৫ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ‘হস্তান্তর, রূপান্তর, স্থানান্তর’ করেছেন। ‘অবৈধভাবে অর্জিত’ তার ১১ কোটি ৪৯ লাখ ৮৪ হাজার ১৬১ টাকা তার ছেলে রাহাত মালিকের নামে দেখানো হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, জাহেদ মালেক ও রাহাত মালেক ছাড়াও জাহেদ মালেকের স্ত্রী শাবানা মালেক, পুত্রবধূ সাকিবা মালেক, মেয়ে সাদিয়া মালেক ও সিনথিয়া আকমলকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিস দেওয়অ হয়েছে।
শাবানা মালেকের নামে তিন কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৮২৭ টাকা, সাকিবা মালেকের নামে ৯ কোটি ২৮ লাখ ৯৪ হাজার ৫৪৫ টাকা, সাদিয়া মালেকের নামে এক কোটি ৮৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সিনথিয়া আকমলের নামে দুই কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার ২৯৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পাওয়ার কথা বলছেন দুদকের অনুসন্ধানকারীরা।
জুনাইদ আহমেদ পলকের ‘জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ’ ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়ার কথা বলা হয়েছে দুদকের মামলার এজাহারে।
এছাড়া ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ‘ঘুষ, দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে’ তিনি ২৪টি ব্যাংক হিসাবে ৩২ কোটি ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৩১৪ টাকা জমা এবং ২৯ কোটি ৮৪ লাখ ৭২ হাজার ৯৫ টাকা তুলে নিয়েছেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
তার স্ত্রী আরিফা জেসমিনের নামে ৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯৩ হাজার ৪৩৩ টাকার ‘জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ’ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। তার নামে ৩১টি ব্যাংক হিসাবে ২২ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার ৯৭৯ টাকা জমা এবং ১৭ কোটি ৫৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৭ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথা বলছেন তদন্তকারীরা।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর গত ২২ অগাস্ট পলকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এক হত্যার ঘটনায় গত ১৪ অগাস্ট গ্রেপ্তার হন তিনি।
মির্জা আজমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তিনি জামালপুর ৩ আসনের সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে ‘নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রভাব খাটিয়ে’ নামে-বেনামে এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ টাকা, মেয়ে মির্জা আফিয়া আজম অপির নামে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭ টাকার ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ’ অর্জন করে ভোগ দখল করছেন।
একই সঙ্গে তিনি পরিবারের সদস্যসহ অন্যান্যদের নামে ২০ কোটি ৭৩ লাখ, ৮২ হাজার টাকার সম্পদ হেবা, দান বা বিনিময়ের মাধ্যমে ‘হস্তান্তর, রূপান্তর’ করেছেন।
তার ও স্ত্রী দেওয়ান আলেয়াসহ স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের নামে খোলা প্রতিষ্ঠানের মোট ৬০টি ব্যাংক হিসাবে গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৭২৫ কোটি, ৭০ লাখ, ৪২ হাজার, ২৩২ টাকা জমা করা হয়। এরমধ্যে ৭২৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৫ টাকা উত্তোলন করে ‘অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে অপরাধলব্দ অবৈধ অর্থ হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তর’ করা হয় বলে দুদকের ভাষ্য।