“বইকে যে কত ভয় পেতে পারে, সত্যকে যে কত ভয় পেতে পারে! অনুষ্ঠানের আগেই আমাকে তারা জেরা করলেন।"
Published : 02 Nov 2024, 07:07 PM
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে লেখা ‘নেতা ও পিতা' বই প্রকাশের পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুটি গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বলে দাবি করেছেন বইটির লেখক শারমিন আহমদ।
তাজউদ্দীনকন্যার ভাষ্য, একদশক আগে ‘ঐতিহ্য’ থেকে বইটি প্রকাশের পর চট্টগ্রামে প্রকাশনা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তাকে গোয়েন্দাদের জেরার মুখে পড়তে হয়।
শনিবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০ দিনের ‘ঐতিহ্য বই উৎসবের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন শারমিন।
তার কথায়, “চট্টগ্রামের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের সদস্যরা এসেছিলেন। আমার সঙ্গে তখন কিন্তু ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীও ছিলেন।
“বইকে যে কত ভয় পেতে পারে, সত্যকে যে কত ভয় পেতে পারে! অনুষ্ঠানের আগেই আমাকে তারা জেরা করলেন।"
শারমিনকে কী জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- তাও উঠে এসেছে তার বক্তব্যে। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সমর্থন নিয়ে মুজিবাহিনী করে, তারা যে মুক্তিযোদ্ধাদেরই আক্রমণ করছিল- এই ঘটনাও তো জানতে হবে। আমি সেটা কেন লিখেছি- তারা (গোয়েন্দারা) সেটা জানতে চান।
“তারা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আমি এটা কেন লিখলাম? আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আপনি যে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এগুলো লিখেছেন, আপনি কী করে জানলেন? মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আপনার বয়স কম ছিল।"
গোয়েন্দাদের জেরার স্মৃতিচারণ করে শারমিন আহমদ বলেন, “আমি তাদের বললাম, আপনি কি পলাশীর যুদ্ধ দেখেছেন? তখন তারা একটু হতবাক হয়ে গেলেন। বললাম, সেই সমসাময়িক যারা লিখেছেন-দেখেছেন, সেসসব তথ্য-উপাত্ত দিয়েই তো ইতিহাস গড়ে ওঠে।
“সেসব তো নিজের চোখে দেখতে হয় না; এখন আমরা আমেরিকার ইতিহাস পড়ছি। আমরা কী করে জানি। তখন উনি চুপ হয়ে গেলেন।"
শারমিন বলতে থাকেন, “কিন্তু ঘটনা ওখানেই শেষ হল না। যখন আমরা ডিনার করতে গেলাম। তখন চট্টগ্রামের ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এনএসআইয়ের প্রধান ওখানে চলে এলেন। আমি মনে মনে হাসলাম।
“একজন বয়োবৃদ্ধ আমীর-উল ইসলাম কী ক্ষতি করতে পারেন? আর আমি তো একটা বই লিখেছি, আমি কী করতে পারি? ঢাল নেই, তলোয়ার নেই। সত্যের শক্তিটাকে এক শ্রেণি যে কী ভয় পেতেন- তারই ছোট্ট একটি উদাহারণ এটি।"
প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে শারমিন বলেন, “তারা তো বইটি তুলে নিতে পারত, তারা সেটি করেনি। তারা শুধু বই প্রকাশ নয়, সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর হয়ে একটি প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে কাজ করে চলেছে।"
শারমিন আহমদের অভিযোগের ব্ষিয়ে এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
২০০০ সালে যাত্রা শুরু করে দুই হাজারের বেশি বই প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। প্রকাশনা সংস্থা চালাতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চক্ষুশূল হওয়ার কথা বলেছেন ঐতিহ্য’র প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান নাইম।
তিনি বলেন, “২০০৯ সালে ‘ক্রসফায়ার: রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড' নামে একটি বই আমরা প্রকাশ করেছিলাম। এর জন্য রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনী থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আমরা কত কপি বই ছেপেছি; বইগুলো কোথায়?
“ওই সময়টাতেই বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটে, পরে তারা আর যোগাযোগ করেননি। ওই যাত্রায় আমরা নিজেদেরকে সেইফ রাখতে পেরেছিলাম।"
পরে আলতাফ পারভেজের লেখা ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ' প্রকাশের পরও একই ধরনের সমস্যা হয়েছিল জানিয়ে নাইম বলেন, “তখন রাষ্ট্রেরই দায়িত্বশীল কারো কারো কাছ থেকে আমি পরামর্শ নিয়েছিলাম যে- কী করা যায়। বইটি প্রকাশ করার পর আমরা প্রচার করিনি।
“কিন্তু বইমেলায় রেখেছিলাম। প্রতিদিন বইমেলায় নতুন বইয়ের একটা প্রেস রিলিজ দিতাম, ওই বইটার কথা ইচ্ছা করেই বলিনি।"
বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের লেখা ‘এক জীবন এক ইতিহাস' বইটি নিয়েও প্রচার করা হয়নি বলে জানান ঐতিহ্য প্রকাশক।
নাইম বলেন, ২০২১ সালে ‘বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ' নামে সাব্বির জাদিদের লেখা বই প্রকাশ করার পর ‘রাষ্ট্রীয় বাহিনীর’ চাপে ৫০০ কপি পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছিল।
বিভিন্ন সময় এসব চাপে থাকলেও কখনো জেলে যেতে হয়নি বলে ‘শুকরিয়া' করে প্রকাশক নাইম বলেন, “আমি আবার কম্প্রোমাইজ করা মানুষ, আমি এত বিপ্লবী না।"
ঐতিহ্যের দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে ১০ দিনের বই উৎসব উদ্বোধন করেন এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, “আজকে বইয়ের ভবিষ্যৎ মানুষের ভবিষ্যতের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ। মুনাফাবাদী বিশ্বব্যবস্থা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, স্বার্থপরে পরিণত করছে। মানুষ বই পড়ায় আগ্রহী না হয়ে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে।
“এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বাংলাদেশের মানুষ এবং সারা বিশ্বের মানুষকে বইয়ের অন্তর্গত মানবিক বাণী ধারণ করেই বেঁচে থাকার ও সুষম পৃথিবী গড়ার লড়াই করতে হবে।"
তরুণ অনুবাদক মাহীন হক বলেন, “ঐতিহ্য প্রকাশনা জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে চলেছে। প্রবীণ ও নবীনের সৃজনশীল অভিযাত্রাকে ঐতিহ্য ধারণ করছে সাহসিকতার সঙ্গে।"
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আগামী ১১ নভেম্বর পর্যন্ত এই বই উৎসব চলবে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। উৎসবে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ে বই সংগ্রহ করতে পারছেন পাঠক।