ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা আর বাস-পিকআপের চাপে সড়কে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
Published : 12 Aug 2024, 11:31 PM
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতা আর প্রাণহানির কারণে সড়কে কমে গিয়েছিল মানুষ ও গণপরিবহন চলাচল, ২৪ দিন পর চলতি সপ্তাহ থেকে থেকে সড়কে ব্যস্ততা আর যানজটের পুরনো চেহারা ফিরতে শুরু করেছে।
মাঝে তুমুল গণআন্দোলনে ক্ষমতাসীন সরকার বিদায় নিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এরপর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে, মানুষেরও চলাচল বেড়েছে।
সোমবার গুলিস্তান, মগবাজার, তেঁজগাও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি ও মহাখালীসহ বিভিন্ন সড়কে ব্যাপক যানজট দেখা গেছে। ভিড়ের কারণে অনেককে রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে।
এদিন বিকাল ৫টায় ফার্মগেট এলাকায় আয়াত পরিবহনের বাসের অপেক্ষায় ছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস; আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর একটি বাস আসলেও অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও উঠতে পারেননি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার এদিক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করা হয়। দুই সপ্তাহের মত যাওয়া হয়নি। তবে এখন রোববার থেকে যাচ্ছি। রোববার যতগুলো বাস ছিল, মনে হয়েছে যাত্রীর তুলনায় ঠিক আছে।
“কিন্তু আজ যেন মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মানুষের তুলনায় বাস কম।”
আন্দোলনের সময় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে কম বের হয়েছে মানুষ। ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের শঙ্কায় গাড়ি নিয়ে বের হননি অনেকেই। তবে এ সপ্তাহ থেকে সেই চিত্র আর নেই। ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা আর বাস-পিকআপের চাপে সড়কে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
তেঁজগাওয়ের নাবিস্কো এলাকায় প্রায় আধা ঘণ্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মোটরসাইকেলচালক আলাউদ্দিন। কোনোভাবেই সামনে-পেছনের কোনোদিকেই যেতে পারছিলেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই কয়েকদিন তো ভালোই ছিল, গাড়ি কম ছিল। এখন এত বেশি গাড়ি যে রাস্তায় এক মিনিট বাইক চালাতে দুইবার ব্রেক ধরা লাগে। এর মধ্যে ঢাকার একেকটা সিগন্যাল হচ্ছে একেকটা অভিশাপ। আধা ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় আটকে আছি।”
অটোরিকশাচালক মনির মিয়া বলেন, “প্রাইভেটকার এই কয়েকদিন কম ছিল, তাই জ্যাম হয় নাই। এখন এইগুলা বাইড়া গেছে আর জ্যাম শুরু হইছে।”
গাজীপুর থেকে আসা সায়েদাবাদগামী বলাকা বাসের চালক বিল্লাল হোসেন বলেন, “এই কয়দিনের গেঞ্জামের কারণে পরিস্থিতি গরম ছিল। তাই গাড়ি নিয়ে বের হই নাই। আজ (সোমবার) একটু ভালো, তাই গাড়ি নিয়ে বের হয়ছি।
“রাস্তায় যাত্রীর সংখ্যাও ভালো আছে। তবে আরও বাড়বে। এখনও অনেক চালক গাড়ি নিয়ে বের হয় নাই। তাদের পুরোপুরি ভয় কাটে নাই।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘর্ষ হয়। ১৮ জুলাই থেকে পরের কয়েকদিন ব্যাপক সংঘাত ও সহিংসতায় প্রাণহানি হয়। বিভিন্ন স্থাপনা, যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। কারফিউ জারির পাশাপাশি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের মৃত্যু ঘিরে পরে সেই আন্দোলন গড়ায় সরকারপতনের এক দফার আন্দোলনে। সেই আন্দোলন ঘিরেও সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণহানি হয়। পরে ৫ অগাস্ট আন্দোলনকারীদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির দিন পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
যাত্রী কম রাতে
সরকারপতনের আগের পাঁচ-ছয়দিন রাতে তেমন যাত্রী পাননি মোটরসাইকেল চালক মো. ইব্রাহিম। এখনও রাতের বেলায় যাত্রী সংকটের কথা বলছেন তিনি।
তার ভাষ্য, “মানুষ এখন রাত ৮টা বেজে গেলেই আর বাইরে থাকে না। খুবই অনিরাপদ বোধ করে। তাই রাতে রাইড পাই না।”
ইব্রাহিম বলেন, “আমি মূলত রাইড শেয়ার করেই আয় করি। বলতে পারেন এটাই আমার পেশা। যখন মানুষ বাইরে কম থাকে, তখন আমাদের সমস্যা হয়। তবে কারফিউ চলাকালে বেশ ভালোই রাইড দিয়েছি। কিন্তু বাইকের জন্য চিন্তা হইত কখন কে কোন দিক দিয়ে এসে একমাত্র অবলম্বনটা পুড়িয়ে দেয়।”
তুমুল গণআন্দোলনের দিন ৫ অগাস্ট সকালে গ্যারেজ থেকে অটোরিকশা নিয়ে বেড়িয়েছিলেন আব্দুস সামাদ। কিন্তু যাত্রী না পেয়ে আর সড়কে আতঙ্কে ফিরে যান তিনি। কোনো আয় হলেও সেদিন গ্যারেজ মালিক বা মহাজনকে ১ হাজার ২০০ টাকা জমা দিতে হয়েছে তাকে।
তার ভাষ্য, “এক সপ্তাহ ধইরা একটা আতঙ্ক নিয়া গাড়ি চালাইছি। কিন্তু এহন আমার আর ডর নাই। আমার না থাকলেও যাত্রীগো ডর আছে মনে হয়, নাইলে রাস্তায় মানুষ কম লাগে কেন?
“মাইনসে ডর কাটতে আরও দুইদিন লাগব। আর রাইতে ছিনতাই হওয়ার ভয় অনেক।”
গাজীপুরগামী প্রভাতী বনশ্রী বাসের যাত্রী আতাবর আলী বলেন, “আজ (সোমবার) মোটামুটি ভিড় মনে হইছে রাস্তায়। মানুষজন কাজে বের হইছে। আমি গাজীপুর থেকে মাল নিতে অনেকদিন পরে আজ আসলাম।”
রোববার থেকে যাত্রী বাড়লেও এখনও আগের মত স্বাভাবিক মনে করছেন না বিআরটিসির মতিঝিল বাস ডিপোর ম্যানেজার মো. মোশারফ হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গতকাল (রোববার) থেকে যাত্রী বেড়েছে। তবে এখনও আগের মত না। আগের মত হতে সময় লাগবে আরও এক সপ্তাহ।”
মোশারফ জানান, দেশে ১৪৮টির মত বিআরটিসির বাস রয়েছে। তবে যাত্রীর সংখ্যা কম থাকায় সবগুলো এতদিন চলাচল করেনি। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় এখন ঠিক কতগুলো বাস চলছে, তাৎক্ষণিক তার সঠিক হিসাব দিতে পারেননি।
সোমবার বিকাল ৫টায় কারওয়ান বাজারে গাজীপুরগামী বিআরটিসি বাসের সহকারী হাবিবুর রহমান বলেন, “মামা এহন যাত্রী কম। তারপরেও এই কয়ডা দিনের চাইতে বেশি আইজ। আন্দোলনের সময়ে তো যাত্রী পাই নাই তেমন।
“গাড়ি বাইর করলেই তেসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ৮ হাজার টাকা যায়। এহন সেই টাকাটা কোনোমতে তুলতে পারি। কিন্তু কর্মচারী, ড্রাইভারের টাকা থাকে না। আর আন্দোলনের দিনগুলায় খালি গাড়ি নিয়া গেছি। রাজস্বের টাকা পকেট থেইকা দিছি।”
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় বনানীর সেতু ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখনও কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে দুই-চার মাস লাগবে বলে জানান বিআরটিএর চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পালের ব্যক্তিগত সহকারী সঞ্জয় দেওয়ান।
অপরদিকে আন্দোলনের সময় ভাঙচুরের কারণে এখনও বন্ধ রয়েছে মেট্রোরেল। এতে অফিসগামী যাত্রীরা পড়ছেন ভোগান্তিতে। সামনের এক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় কার্যক্রম শুরুর আশা করছেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক।