সচিবালয় ছাড়িয়ে এ ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোতেও।
Published : 16 Aug 2024, 01:39 AM
ক্ষমতার পালাবদলে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়েও; দীর্ঘদিনের পদোন্নতি বঞ্চিতদের ভিড়ে মিছিল-সমাবেশের মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে। দীর্ঘদিন কোনঠাসা কর্মকর্তারা ভালো পদায়নের প্রত্যাশায় ধর্ণাও দিতে শুরু করেছেন।
চলতি সপ্তাহে রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রথম দিন অফিস চালুর পর থেকেই সচিবালয়ের নিয়মিত চিত্র এটি; সবার আলোচনার কেন্দ্রেও বদলি ও পদোন্নতির বিষয়টি। পুরো সপ্তাহজুড়েই জনপ্রশাসন ভবনের বারান্দায় দেখা গেছে কর্মকর্তাদের জটলা, যা ক্রমেই বেড়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারর পতনের পর থেকে জনপ্রশাসন বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগে দিনকে দিন কর্মকর্তাদের ভিড় বেড়েছে।
এ অনুবিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, গত রোববার থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০০টি পদোন্নতির আবেদন জমা পড়ছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সবুজ সংকেতের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেই দেখভাল করা হয়।
শুধু কর্মকর্তারা নন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন। সরকার বদলের সুযোগে নতুন সরকারের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দিতে নিয়মিত মিছিল-জমায়েত করে যাচ্ছেন ভবনগুলোর মধ্যকার অলিগলিতে।
সচিবালয় ছাড়িয়ে এ ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোতেও। রাজধানীর বিভিন্ন অংশে অবস্থিত এসব প্রতিষ্ঠানে বদলি ও পদোন্নতি নিতে দৌড়ঝাঁপ চলছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছাত্র-জনতার বিপুল অংশগ্রহণে সরকার পতনের গণ আন্দোলনে রূপ নেয় অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে। তুমুল আন্দোলনে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। শুরু হয় ক্ষমতার পালাবদলের ধারা। এতদিন প্রশাসনে দাপট দেখানো অনেকেই সচিবালয়ে আসা বন্ধ করে দেন।
এর বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগেই দীর্ঘদিন থেকে নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা কর্মকর্তারা সচিবালয়ে আসতে থাকেন। নিজেদের দাবি দাওয়া আদায়ে সোচ্চার হতে শুরু করেন।
নতুন উপদেষ্টা পরিষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের শীর্ষস্তরে পরিবর্তনও শুরু হয়। একে একে সরে যেতে শুরু করেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তারা; রদবদলও হয়েছে অনেক পদে।
আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন অনেক বিভাগ, সংস্থা ও অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্তা ব্যক্তিরা। বিভিন্ন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগ, রদবদল ও পরিবর্তনের মিছিল গত কয়েকদিন ধরে ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। শীর্ষ স্তরের দায়িত্বে আসছে নতুন মুখ। অব্যাহতির পাশাপাশি দায়িত্বের বদলও ঘটছে।
এ ঢেউয়ের রেশ মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও পড়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সপ্তাহজুড়ে নিয়মিত বদলি, পদোন্নতি ও নতুন নিয়োগের প্রক্রিয়া বেশ জোরেশোরেই চলছে।
এরইমধ্যে ১১তম থেকে ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগ পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদায় আটকে থাকা ১১৭ জনকে উপসচিব হিসেবে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
এরপর ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএসে নিয়োগ বঞ্চিত ২৫৯ জনকে নিয়োগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নবনিয়োগ শাখা থেকে প্রজ্ঞাপান জারি করা হয়েছে। আগামী ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদেরকে কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে।
সরকার পতনের সুযোগে সচিবালয়ে দৌঁড়ঝাপে থাকা বঞ্চিতদের অভিযোগ, পতিত সরকারের অন্যায় আদেশে সম্মতি না দেওয়ার কারণে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। তবে এবার যখন দল নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদোন্নতি দেওয়া শুরু করেছে সেখানেও ‘আওয়ামী লীগের দলবাজ’ কিছু লোকজন পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছে।
তাদের ভাষ্য, আবার ন্যায্য দাবি করার কারণে প্রশাসনের শীর্ষপদে থাকা আওয়ামী লীগের সুবিধা পাওয়া সচিবদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে এতদিনের বঞ্চিতদের।
বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অনেকে অভিযোগ করছেন, এতদিন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশাসনে বঞ্চিত হয়েছেন এমন অনেকেই নতুন প্রশাসনে এসে মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। ফলে চলমান পদোন্নতি প্রক্রিয়া ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের ক্ষোভ কমাতে পারছে না।
এক কর্মকর্তা উদাহরণ হিসেবে ১৩তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া নাজমুল আমিন মজুমদারের নাম সামনে আনলেন। অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক পলিসি ও ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী এ ক্যাডার কর্মকর্তা ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিবের পিএস ছিলেন।
নাজমুল আমিনের ব্যাচে তার কয়েকজন ঘনিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, “এরপর নতুন সরকারের সময়ে তিনি আর পদোন্নতি পাননি। বিভিন্ন ডাম্পিং পোস্টিংয়ে থাকা অবস্থায় বইপুস্তক লিখে দিন কাটিয়েছেন। ব্যাচের বন্ধুরা সব অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পর্যায়ে চলে গিয়েছেন। গত মে মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে নির্যাতনও করে। এক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।”
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পদোন্নতির তালিকায় নাম আসেনি নাজমুল আমিনেরও।
বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা উপসচিব আবুল কালাম আজাদ প্রশাসনের পদোন্নতি বঞ্চিতদের নিয়ে চলমান জমায়েত ও দৌড়ঝাঁপে সক্রিয় ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে তাকে বর্তমান কর্মস্থল স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ-২ শাখা থেকে বদলি করে লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে সংযুক্ত করে পাঠানো হয়। গত বুধবার জারি করা ওই আদেশে তাকে পরের দিনই কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে আবুল কালাম অভিযোগ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশাসনে এখনও আওয়ামী লীগের শয়তানগুলো সক্রিয় রয়েছে। বিগত সরকারের প্রভাবশালী সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে আমাকে বদলি করেছে। কারণ আমি বঞ্চিতদের পদোন্নতির বিষয়ে সরব ছিলাম।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে পরিচিতি পেয়েছিলেন ২২তম বিসিএসের কর্মকর্তা মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।
তিনি দীর্ঘদিন উপসচিব হিসেবে থাকলেও তার ব্যাচের অন্যরা যুগ্ম সচিব পর্যায়ে চলে গেছেন।
শাহরিয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের সরকারের সময়ও আমার দলীয় পরিচয় ছিল না। এখনও আমার কোনো দলীয় পরিচয় নেই। সে কারণে আমি দৌঁড়ঝাপ করতেও যায়নি। কর্তৃপক্ষ যখন ভালো মনে করবে তখন পদোন্নতি দেবে, এর বাইরে আর কিছু চাওয়ার নেই। তবে আমি বঞ্চিতদের একজন, এটা খুবই সত্য কথা।”
ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানও ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ব্যাচের অনেকেই সচিব হয়েছেন। তার চাকরিও আছে আর এক বছরের কিছুটা বেশি। কিন্তু বার বার পদোন্নতি বঞ্চিত এই কর্মকর্তা কোথাও দৌড়ঝাঁপ করতে যাননি।
“আমি দৌড়ঝাঁপ করব কেন? আমাকে যখন যেই দায়িত্ব দেওয়া হয় সেটা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করি। এখন নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি হলে হবে, না হলে আল্লার কাছে বলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই,” হতাশর সুর তার কণ্ঠে।
শুধু সচিবালয়েই নয়; বদলি পদোন্নতির ধাক্বা পড়েছে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর সংস্থাগুলোতেও।
মৎস্য অধিদপ্তরের ষষ্ঠ থেকে নবম গ্রেডের অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তাকে সম্প্রতি বদলি করা হয়েছে বলে জানান সেখানকার একজন উপপরিচালক। ষষ্ঠ গ্রেডের নিচে আরও ১৭ জন কর্মকর্তার বদলির জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপিপন্থি কিছু লোক একটি তালিকা ডিজিকে ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি সেই অনুযায়ী কাজ করছেন।”
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) সৈয়দ মো. আলমগীরকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কীভাবে বদলি হচ্ছে পদোন্নতি হচ্ছে, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। কেবল যে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিতদের পদোন্নতি হচ্ছে তা নয়; অযোগ্যতা, অদক্ষতার কারণে পিছিয়ে পড়া লোকজনও এই সুযোগে পদোন্নতি নিয়ে নিচ্ছে।
এপিডি শাখার নতুন অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রউফের দফতরে গিয়ে তার ব্যস্ততা ও কর্মকর্তাদের ভিড়ের কারণে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
এ অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমানের সঙ্গে ফোনে বদলি, পদোন্নতি ও বঞ্চিতদের দাবি দাওয়াও বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।
ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি: উপসচিব হলেন 'বঞ্চিত' ১১৭ কর্মকর্তা
পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা