বিনোদন নিতে আসা নতুন নতুন মানুষের মুখোমুখি হওয়া এবং খাঁচার নিশ্চল জীবন চিড়িয়াখানার বেশিরভাগ প্রাণীকে ‘আচরণগত বৈকল্যে’ ভোগাচ্ছে।
Published : 07 Jul 2024, 01:44 AM
‘তারা’ নামে একটি এশিয়ান কালো ভাল্লুক মাথা উল্টো দিক করে খাঁচার ভেতরে ঘুরছে। তা দেখতে সেখানে দর্শনার্থীর ভিড়ও বেশি।
ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় গেলে দেখা মেলে খাঁচাবন্দি ‘তারা’র। তার মাথা উল্টে ঘোরান দৃশ্য দর্শনার্থীদের আমোদ দিলেও এমন আচরণ প্রকৃতিতে থাকা ভাল্লুকদের চেয়ে ‘আলাদা’ ও ‘উদ্ভট’ বলে মনে করছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
প্রকৃতিতে মুক্ত থাকা ভাল্লুক ঘাষ, ফুল, ফল, ছোট্ট প্রাণী, মধু- এসব খায়। আর খাবার খুঁজতে প্রতিদিন বন-জঙ্গলে কয়েক কিলোমিটার পথ মাড়াতে হয়। ক্ষুধা মেটাতে চড়তে হয় গাছেও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতিতে স্বাভাবিক চলাচলের যে সুযোগ, খাঁচায় তা না মেলায় ‘আচরণগত বৈকল্যে’ ভুগছে ‘তারা’।
বন্যপ্রাণী, চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক বিশেষজ্ঞ রেজা খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খাঁচায় বন্দি রাখায় চিড়িয়াখানার প্রাণীরা স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না।
“এ রকম ঘরবন্দি রাখলে ভাল্লুক মাথা উল্টো দিক করে হাঁটবে, বানর খাঁচার দেয়ালে মাথা ঠুকবে বা এক পাশে উল্টো হয়ে আরেক পাশে চলে যাবে। বন্দিদশায় প্রাণীর আচরণগত বিকারের ফল এসব।”
জাতীয় চিড়িয়াখানার বিদ্যমান কাঠামো প্রাণীদের স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন পিপল ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার (প) ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “খাঁচা অমানবিক। এমন ডিসপ্লে (প্রদর্শনী) ব্যবস্থা সভ্য সমাজে থাকা উচিত নয়। চিড়িয়াখানায় আসা দর্শনার্থীদের চিৎকার, গাড়ির শব্দ, প্রাচীরের পাশের আবাসিক এলাকা থেকে আসা শব্দ খাঁচাবন্দি প্রাণীদের বিরক্ত করে।”
এমিল বলেন, জাতীয় চিড়িয়াখানার দেয়াল ঘেঁষে গাছপালা আরো বেশি থাকা উচিত ছিল, যাতে শব্দ এবং দূষণের ঝুঁকি কমানো যায়।
চিড়িয়াখানায় শিশুপার্ক কতটা যৌক্তিক?
দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন সময় এমন সব অনুষঙ্গ জাতীয় চিড়িয়াখানায় যুক্ত করা হয়েছে যা প্রাণীদের অস্বস্তির কারণ ঘটাচ্ছে। এমনই এক উদ্যোগ হল শিশু পার্ক, যা ২০২১ সালে চালু করা হয়।
ওই পার্কে শিশুদের চিত্ত বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইড, সেগুলো চালানোর সময় উচ্চশব্দে গান বাজতে থাকে। অথচ পার্কটির চারপাশ ঘিরে রয়েছে পশুপাখির খাঁচা।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিড়িয়াখানায় উচ্চ শব্দ প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বৈকল্য তৈরি করে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিড়িয়াখানাকে নতুন করে সাজানোর যে পরিকল্পনা করেছি, সেখানে বিষয়গুলো (পার্ক ও শব্দ দূষণ) বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মসজিদের পাশটি ‘ফ্রি জোন’ হিসেবে রেখেছি, যেখানে কোনো প্রাণী রাখা হবে না।”
জাতীয় চিড়িয়াখানার ওয়েবসাইটে একে ‘জাতীয় পর্যায়ে চিত্ত বিনোদনের একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান’ বলা হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৪০ লাখ মানুষ বিনোদনের উদ্দেশ্যে চিড়িয়াখানা পরির্দশন করে।
প্রাণী অধিকার কর্মীরা বলছেন, চিড়িয়াখানাকে ‘বিনোদনকেন্দ্র’ হিসেবে নেওয়ায় এই প্রাণীদের জীবনে ‘উৎপাত’ বাড়ছে।
চিড়িয়াখানায় দেখা যায়, উপচে পড়া দর্শনার্থী খাঁচায় থাকা প্রাণীদের বিরক্ত করছে। কেউ শুয়ে থাকা প্রাণীদের ডেকে তোলার চেষ্টা করছে, খাঁচা ধরে হাউমাউ বা উদ্ভট শব্দ করে প্রাণীদের দৃষ্টি কাড়ছে।
মানুষের এমন আচরণে বিরক্ত প্রাণীগুলো খাঁচার একেবারে পেছনের কিনারে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকছে, সে দিকে কারও খেয়াল নেই।
সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় গিয়ে একটি খাঁচার সামনে দেখা গেল অদ্ভুত আচরণ করছেন এক তরুণ। খাঁচায় কয়েকটি অন্তঃসত্ত্বা বানর গুটিসুটি মেরে বসে আছে। সেই তরুণ নোংরা ভাষায় কথা বলছিলেন। বানরদের উত্ত্যক্ত করে নিজেই মজা পাচ্ছিলেন। ওই তরুণের কথা না বুঝলেও ভেংচি কেটে চিৎকার দিয়ে বানরগুলোকে খাঁচার দূর প্রান্তে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসতে দেখা গেল।
কিছুটা দূরে উল্লুকের চিৎকারের সঙ্গে গলা মেলাতে শোনা গেল একদল দর্শনার্থীকে। বানরের খাঁচার সামনে ‘বাদরামিতে’ মত্ত তরুণটিও তখন দৌড়ে গিয়ে ওই দর্শনার্থীদের সঙ্গে গলা মেলালেন। তারা সবাই ছিলেন ‘বিনোদনমুখর’।
কেন প্রাণীদের বিরক্ত করছেন? প্রশ্ন শুনে দমলেন না সেই তরুণ, বরং তার আনন্দ যেন আরো বাড়ল। হাসিমুখে বললেন, “তাদের (বানরদের) উৎসাহ দিই।”
চিড়িয়াখানার প্রাণীদের ‘উৎসাহ’ দেওয়ার দায়িত্ব কে দিয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন না ওই তরুণ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে নিজের নামটিও জানাতে রাজি হলেন না।
খাঁচাবন্দি প্রাণীদের প্রতি ওই তরুণের ‘উদ্ভট’ আচরণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চিড়িয়াখানায় এমন দৃশ্য নিয়মিত দেখা যায়। দর্শনার্থীদের একটি অংশ প্রাণীদের উত্ত্যক্ত করে মজা পান। খাঁচায় ঢিল ছোড়েন, খাঁচা ধরে ঝাঁকিয়ে ঘুমন্ত প্রাণীকে জাগিয়ে তোলেন, যা-তা খাবার দেন এবং না খেলে চেচামেচি করেন।
জরিমানার নিয়ম আছে, প্রয়োগ নেই
২০২৩ সালের চিড়িয়াখানা আইন অনুযায়ী, কোনো দর্শনার্থী চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণীকে উত্ত্যক্ত করলে তাকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান আছে। প্রাণীকে আঘাত বা জখম করলে অথবা অনুমতি ছাড়া খাবার দিলে দুই মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের কথা বলা আছে।
চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা যায়, ‘বিনোদনমুখর’ দর্শনার্থীরা আইন ভাঙার বহু ঘটনা ঘটাচ্ছেন। অথচ জরিমানা বা শাস্তি তো দূরে থাক, তাদের নিবৃত করতে কেউ এগিয়ে আসছেন না।
অবশ্য মাইকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা জানিয়ে প্রাণীদের বিরক্ত না করতে বলা হচ্ছে। তবে তা যেন কলের গানের মত বেজে চলেছে। কেউ তা মানছে না। শব্দদূষণ ছাড়া ওই সচেতনতার বার্তার কোনো কার্যকারিতা দেখা গেল না।
এই ‘অনর্থক’ সাবধানবাণীর মতই নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার বার্তা লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে চিড়িয়াখানার বিভিন্ন জায়গায়।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার বললেন দর্শনার্থীদের ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ রোখার মত জনবলের ঘাটতির কথা।
“কয়েকটি খাঁচায় একজন করে পাহারায় থাকে। কোথাও কোথাও চারটি খাঁচার জন্য একজনকে রাখা হয়। প্রতিটি খাঁচা পাহারা দেওয়ার মত জনবল আমাদের নেই।”
বন্দিদশার প্রভাব কতটা?
উল্লুক কিংবা বানরের জীবন কাটবার কথা গাছের ডালে। জাতীয় চিড়িয়াখানায় তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছে খাঁচায়। সেখানে তাদের জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।
প্রতিটি প্রাণীই প্রকৃতিতে থাকে নিজের মত করে। সেই সুযোগ চিড়িয়াখানায় কই? জায়গাটিকে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করায় এসব প্রাণীর আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে।
উটপাখির খাঁচার ভেতরে পড়ে ছিল চকোলেটের খোসা। তাতে ঠোকরাতে দেখা গেল এক উট পাখিকে।
বিভিন্ন খাঁচার সামনে ঘুরে দেখা গেল, ইমু চুপচাপ বসে আছে, বাঘ শুয়ে আছে, খাবার ফেলে ঝিমাচ্ছে সিংহ। অবসন্ন দেখা গেল বেশিরভাগ প্রাণীকে; সহজাত চাঞ্চল্য কারো মধ্যে নেই।
বিনোদন নিতে আসা নতুন নতুন মানুষের মুখোমুখি হওয়া এবং খাঁচার নিশ্চল জীবনই চিড়িয়াখানার বেশিরভাগ প্রাণীকে ‘আচরণগত বৈকল্যে’ ভোগাচ্ছে বলে মনে করেন রাকিবুল হক এমিল।
তিনি বলেন, “একেকটি প্রাণীর স্বভাব একেক রকম। সেনসিটিভিটির মাত্রাও ভিন্ন। এরা নিজেদের পরিষ্কার রাখতে চায় সবসময়। অথচ দেখলাম বাঘের দিকে মাংস ছুঁড়ে মারছে, সারস ও উট পাখি নিজেদের বমি নিজেরা খাচ্ছে; এগুলো অস্বাভাবিক আচরণ।”
এই প্রাণী অধিকারকর্মীর মতে, নতুন প্রাণীদের জন্ম খাঁচায় হলেও তারা বংশগতভাবে খোলামেলা পরিবেশ চায়। তাদের জীবনের বড় যে বৈশিষ্ট্য শিকার করা, এখানে তা করতে না পারায় তারা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
“বেঁচে আছে, কিন্তু অস্বাভাবিকতায় মৃতপ্রায় এসব প্রাণী। খোলামেলা পরিবেশ তৈরি করলে দর্শনার্থীরা দূর থেকে এদের দেখতে পারত, তখন বিরক্ত করত না। বাঘের খাঁচায় এমন সব নেট লাগানো যে, একটু দূর থেকে দর্শনার্থীরা এদের দেখতে পায় না। ফলে খাঁচার কাছে ভিড় জমায়।”
রাকিবুল হক এমিলের ভাষ্য, খোলা চোখে সাধারণ মানুষ ধরতে পারে না বলে খাবার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ‘টেকনিক্যাল’ বিষয়গুলোতে কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ সেগুলোই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
‘বিনোদনকেন্দ্র নয়’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিড়িয়াখানাকে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে দেখে, পৃথিবীর কোথাও তেমনটি নেই। এখানকার মানুষ বা কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় এটি বিনোদনের জায়গা।
জাতীয় চিড়িয়াখানার ওয়েবসাইটে গিয়ে ‘আমাদের সম্পর্কে’ বিভাগের ‘এক নজরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা’ সাব-ক্যাটাগরিতে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সেখানে চিড়িয়াখানাটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্যের এক নম্বরে রাখা হয়েছে ‘বিনোদন’।
অধ্যাপক নাসের বলেন, “কিন্তু চিড়িয়াখানা বিনোদনকেন্দ্র নয়। এটি এমন একটা জায়গা, যেখানে বিপন্ন প্রাণীগুলোকে রাখা উচিত, যত্ন নেওয়া উচিত। শব্দে তারা বিরক্ত হয়, কিন্তু বলতে পারে না। তার সাইকোলজি, আচরণ, খাদ্য সব কিছুতেই প্রভাব ফেলে। সে ঠিক মত খাবে না, শব্দ শুনে খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।”
আধুনিক চিড়িয়াখানা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে দুবাই সিটি করপোরেশনের বন্যপ্রাণিবিষয়ক পরামর্শক রেজা খানের সঙ্গে কথা হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
তিনি বলেন, গত শতাব্দীর ষাটের দশকের ধারণা দিয়ে চলছে বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা। নতুন শতাব্দীর চিড়িয়াখানার ধারণার কোনো প্রতিফলন এখানে ঘটেনি, কোনো পরিবর্তনও আনা হয়নি।
“জাতীয় চিড়িয়াখানা মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠান। যারা এখানে আছেন, তারা প্রাণীদের বিষয়ে ভালো জানেন না। সাধারণত চিড়িয়াখানা পরিচালিত হয় বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিবিদদের হাতে, যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেন। যে ব্যক্তি প্রকৃতিতে বাঘ দেখেননি, তিনি কী করে বুঝবেন বাঘের জীবনচক্র কেমন? সে কারণে আমাদের চিড়িয়াখানা মানুষের ঘরবাড়ির মত তৈরি হয়েছে।”
চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা যায়, প্রকৃতিবর্জিত পরিবেশের প্রভাব পড়ছে প্রাণীর স্বাস্থ্যে। সেই পুরোনো অবকাঠামোতে চলছে সব।
রেজা খান বলেন, “প্রাণীদের পায়ের তলাটা শক্ত জায়গায় চলার জন্য তৈরি হয়নি। পাঁচ-ছয় বছর গেলে শক্ত জায়গায় থেকে ব্যথা শুরু হয় এদের। অথচ চিড়িয়াখানার কেউ জানেন না যে এমন স্থান এদের বসবাসের অযোগ্য।”
হারাচ্ছে প্রজনন ক্ষমতা
জাতীয় চিড়িয়াখানার নির্দেশিকায় এর প্রতিষ্ঠার যে ছয়টি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, তার দুই নম্বরে আছে ‘দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সংগ্রহ ও প্রজনন’ এবং চার নম্বরে আছে ‘প্রাণী বৈচিত্র্য সংরক্ষণ’।
অথচ শকুনগুলো প্রজনন সক্ষমতা হারানোয় চিড়িয়াখানা শকুনশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
১৯৭৯ সালে মিরপুর চিড়িয়াখানায় প্রথম শকুন সংরক্ষণ শুরু হয় তিনটি শকুন রাখার মধ্য দিয়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাতে ধরা পড়া আরও চারটি শকুন এখানে আসে।
২০১৬ সালে বিপন্ন প্রজাতির একটি বুড়ো পুরুষ শকুন মারা যাওয়ায় এখন টিকে আছে ছয়টি। জাতীয় চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দি হওয়ার পর থেকে তারা একবারও প্রজনন করেনি। অথচ খাঁচার ভেতরে এদের জীবন এখন শেষের দিকে।
চিড়িয়াখানায় শকুনের প্রজনন না হওয়ার ঘটনাকে ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখছেন অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের। চিড়িয়াখানায় প্রতিটি প্রাণীর প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন কাটানোর ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
“প্রকৃতিতে তারা যেভাবে থাকে, সেরকম পরিবেশ দরকার। তাহলে এরা ভাবতে পারত, ‘ও এটা আমার বাসা।’ কিন্তু তাকে একটা খাঁচায় রেখে ডিম পাড়তে বললে সে তো পারবে না। অক্সিজেন কিছুটা কম পেলেও শকুন উঁচু গাছে থাকে, খায়ও বেশি। এগুলো নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
“বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানায় বিরল প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রজননের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিড়িয়াখানার সঙ্গে গবেষকরা থাকায় এগুলো সম্ভব হচ্ছে। জাতীয় চিড়িয়াখানাতেও তেমন গবেষক রাখতে হবে।”
সংস্কার চান বিশেষজ্ঞরা
ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বর্তমানে জাতীয় চিড়িয়াখানার ১৩৭টি খাঁচায় ২৩৭টি প্রকোষ্ঠে ১৩৫টি প্রজাতির ৩৩৪২টি প্রাণী ও অ্যাকুরিয়াম ফিশ রয়েছে। প্রতিবছর এসব প্রাণী দেখতে আসছে প্রায় ৪০ লাখ দর্শনার্থী।
কোভিড মহামারীর লকডাউনে চিড়িয়াখানাও বন্ধ ছিল। জনসমাগম না থাকায় সে সময় প্রাণীরা তুলনামূলক ভালো ছিল। অযাচিত শব্দ ছিল না। ঢিল ছোড়া হয়নি, উত্ত্যক্তকারীরাও ছিল না।
জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক পরিচালক আব্দুল লতিফ বলেন, “সেসব কারণে তখন প্রজনন হার বেশি পাওয়া গেছে, অনেক বাচ্চা দিয়েছে তারা। পরেও এর ফল পাওয়া গেছে।”
তবে চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের প্রজনন হারের চেয়েও এদের স্বস্তিতে বাঁচার জন্য উপযুক্ত বাসস্থান বা বিচরণভূমি নিশ্চিত করাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন রেজা খান।
“এখানে প্রাণীর অধিকার ব্যাহত হচ্ছে। বাঘের বাচ্চা হলে কী করা হবে? একে তো পৃথিবীর কোথাও ছাড়া যাবে না। এর পেছনে খরচও বেশি হচ্ছে।”
রেজা খান বলেন, বিশ্বের কোনো আধুনিক চিড়িয়াখানায় এখন প্রাণীদের খাঁচায় রাখা হয় না। দিনে তাদের উন্মুক্ত রেখে রাতে আলাদা ঘরে রাখা হয়, সেই ঘরের মেঝেটাও হয় আরামদায়ক।
“মানুষ তাদের দেখলেও কোনো নেট-প্রাচীর বা আর্টিফিশিয়াল দেয়ালের বাইরে থেকে দেখবে, প্রাণীদের চোখে তারা পড়বে না। এদের মুক্ত রাখতে হবে এবং সেবা করার জন্য বিশেষজ্ঞ লাগবে।”
রেজা খান জানান, এক জোড়া বাঘ রাখার জন্য প্রায় ২০০ বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন; যেখানে তারা চলাফেরা করতে পারবে। ছায়া দেওয়ার গাছ, অল্প উচ্চতার গাছপালা থাকতে হবে, যার ওপরে বাঘ বা গাছে থাকা প্রাণীগুলো উঠতে পারবে। কংক্রিটের ফ্লোর থাকা চলবে না। এদের বাচ্চা হওয়ার পর প্রশিক্ষণও দিতে হবে। যেমন, এক দিন খাবারটা একটু উঁচুতে, পরের দিন আরেকটু উপরে রাখতে হবে; যাতে সে পরিশ্রম করে খায়।
“এতে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের যেমন এক্সসারসাইজ হয়, তেমনি এদের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। খাবারটা তার গায়ে লাগে। অন্যান্য দেশ চিড়িয়াখানায় গাছের ওপরে খাবার রাখা হয়, ভাল্লুককে সেখান থেকে পরিশ্রম করে খেতে হয়।”
অধ্যাপক নিয়ামুল নাসেরের মতে, প্রাণী সংরক্ষণের জন্য জাতীয় চিড়িয়াখানা থাকা দরকার; তবে একে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে, বদলাতে হবে এর নকশা।
“খাঁচার মধ্যে নেট না দিয়ে গ্লাস দেওয়া থাকবে, ভেতর থেকে প্রাণীটা আমাকে দেখবে না, কিন্তু আমি তাকে দেখব। তার কাছে যেন কোন শব্দ না যায়, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে।
“চিড়িয়াখানা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখতে হবে সপ্তাহে দুদিন। এই দুই দিনে কত টিকেট দেওয়া হবে, তা নির্দিষ্ট থাকবে। দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়িয়ে প্রাণীদের বিরক্ত করা যাবে না। এদের বিশ্রাম দিতে হবে।”
মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন কবে
২০১৯ সালে মিরপুর চিড়িয়াখানার সঙ্গে রংপুর চিড়িয়াখানার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছিল সরকার। অথচ তা আজও অনুমোদন হয়নি।
চিড়িয়াখানার সাবেক পরিচালক আব্দুল লতিফ ২০২১ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আভাস দিয়েছিলেন, মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে ১৫ বছর লেগে যেতে পারে।
মহাপরিকল্পনার আওতায় চিড়িয়াখানাকে পাঁচটি জোনে ভাগ করার কথা। দেশি প্রাণীদের ‘বাংলাদেশ হ্যাবিটেট জোন’, আফ্রিকার প্রাণীদের ‘আফ্রিকান হ্যাবিটেট জোন’, পোষা প্রাণীদের জন্য আলাদা জোন করার পাশাপাশি শিশু দর্শনার্থীদের খেলাধুলার জন্য ‘অ্যাকটিভ জোন’, ‘নিশাচর প্রাণী জোন’ করার কথা রয়েছে ওই পরিকল্পনায়।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত চিড়িয়াখানার কোনো সমস্যাই সমাধানের উপায় দেখছেন না পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার।
তাহলে সে পর্যন্ত প্রাণীরা কষ্ট পেতেই থাকবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিড়িয়াখানার ফটক ব্যবস্থাপনা এখনও সনাতন নিয়মে চলছে; সেটা আধুনিকায়নের চিন্তা করা হচ্ছে।
“আগে থেকেই টিকেট কেটে আসবে, এটা করতে পারলে দর্শনার্থীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত থাকবে। আর মানুষকে তো বিকল্প বিনোদন দিতে হবে। আবার এটা শিক্ষারও একটা জায়গা। এটা ছাড়া তারা যাবে কোথায়? দেশের চিড়িয়াখানার সংখ্যা বাড়ানো দরকার। সেটা যদি পারা যায়, তাহলে দর্শনার্থীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।”
সরকার প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একজন ঠিকাদারকে চিড়িয়াখানার ফটক লিজ দেয়। ৩০-৪০টির মত শর্ত মেনে ১০ বা ১২ কোটি টাকায় ঠিকাদার এই লিজ নেয়।
রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বিশেষ দিনগুলোতে চিড়িয়াখানায় প্রায় ২ লাখ দর্শনার্থী প্রবেশ করে, যা প্রাণীদের জন্য ধকলের কারণ হয়। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা কমানো সম্ভব হবে।
“তবে এই প্রক্রিয়ায় যত বেশি দর্শনার্থী আসবে, ঠিকাদারের তত লাভ হবে।”
মহাপরিকল্পনা কবে বাস্তবায়িত হবে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাস্তবায়নের জন্য তো আনুষ্ঠানিক অনেক কিছুর প্রয়োজনীয়তা আছে। ঠিক কবে করা যাবে, তা এখন সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।”
জাতীয় চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা বদলি হওয়ায় দীর্ঘসময় কোনো কর্মকর্তার পক্ষে নির্দিষ্ট প্রাণীকে দেখভাল করার সুযোগ হয় না। এ বিষয়ে প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী বলেন, “চিড়িয়াখানা যাতে ভালোভাবে চলে, সেভাবেই লোক নিয়োগ দেওয়া হবে।”
দেশের বাকি চিড়িয়াখানাগুলো নতুন করে সাজানোর ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “প্রক্রিয়া তো শুরু হয়েছে, বাকিগুলোর কাজ ধীরে ধীরে করা হবে।”
পুরনো খবর
শকুনকে চিড়িয়াখানায় টিকিয়ে রাখাও এখন কেন মুশকিল?
সঙ্গীহীন খাঁচাবন্দি জীবনে অস্থিরতা