ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথি কক্ষে বুধবার রাতে মানসিক ভারসাম্যহীন ৩২ বছর বয়সি তোফাজ্জল হোসেন নির্যাতনের শিকার হন।
Published : 20 Sep 2024, 06:44 PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করছে আদালত।
শুক্রবার শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম ছয় শিক্ষার্থীকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করলে তারা স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা লিপিবদ্ধ করার আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
ঢাকার মহানগর হাকিম সাদ্দাম হোসেন ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৬৪ ধারায় তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করছেন বলে তথ্য দিয়েছেন প্রসিকিউসনের আদালত পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান।
এই ছয়জন শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছেন ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জালাল মিয়া (২৫), মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সুমন মিয়া (২১), পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মো. মোত্তাকিন সাকিন, ভূগোল বিভাগের আল হোসেন সাজ্জাদ, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ এবং ওই হলের আরেক শিক্ষার্থী ওয়াজিবুল আলম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথি কক্ষে বুধবার রাতে ৩২ বছর বয়সি তোফাজ্জল হোসেন নির্যাতনের শিকার হন।
রাত ১২টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তোফাজ্জলকে মারধরের আগে তাকে ভাত খাওয়ানো হয়, তখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ভাত খেতে তার কেমন লাগছে।
খবর রয়েছে, ভাত খাওয়ানোর পর তাকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি উঠেছে।
তোফাজ্জলকে ধরে মারধর করা হচ্ছে, জানতে পেরে তার মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রের নম্বর ফোন দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। সে যে মানসিক ভারসাম্যহীন, তা তাদের বলেছিলেন তানিয়া। তবে তারা শোনেননি।
তানিয়ার অভিযোগ, এরপর তাকে আরও বেশি করে মারধর করা হয়।
তোফাজ্জলের স্বজনেরা বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসেছিলে মরদেহ নিতে। তারা বলছেন, হলের ছাত্ররা তোফাজ্জলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে তাদের ফোন করে তার মুক্তির জন্য টাকা চেয়েছিল। আর তার কেন এত নম্বর মুখস্থ, সেজন্য আরও মারধর করে।
মধ্যরাতে যখন তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় ততক্ষণে তার মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে ছিল মারধরের অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন।
ঢাকা মেডিকেল মর্গে নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কাজী গোলাম মোকলেসুর রহমান বলেন, নিহতের সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
জীবনের করুণ কাহিনী
তোফাজ্জলের জীবনের কাহিনি বেশ করুণ।
মর্গে আসা মামাত বোন আসমা আক্তার তানিয়া বলেন, “দুই ভাই আর বাবা-মা মিলে ছিল তোফাজ্জলদের সুখী পরিবার। আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তোফাজ্জলের বাবা মারা যান। পাঁচ বছর আগে মারা যান তার মা।
“ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। তখন তার বড় ভাই পুলিশের এসআই নাসির হোসেন তোফাজ্জলকে দেখেশুনে রাখতেন, মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতেন। সেই ভাইও গত বছর রোজায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর থেকেই ওকে দেখার আর কেউ নাই। ও পথে পথে একেবারে উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।”
তানিয়া বলেন, তারা তোফাজ্জলকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাকে ধরে বেঁধে কোথাও নেওয়া যায় না বলে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। সবশেষ তাকে যেদিন পাবনার মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার কথা ছিল, সেদিন সকালে শিকল ভেঙে পালিয়ে যান তিনি।
এরপর ঢাকায় সে এখানে ওখানে থাকতেন, ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন।
তানিয়া বলেন, “৫ তারিখ (৫ অগাস্ট) রাজু ভাস্কর্যের সামনে যখন টেলিভিশনগুলো লাইভ চলছিল তখন যে বারবার সামনে আসছিল। সে সাক্ষাৎকার দিতে চায়। ওর সেই ভিডিও আমরা দেখছি।”
তোফাজ্জলদের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করলেও মানসিক সমস্যার কারণে কোনো কাজকর্ম করছিলেন না।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই ঘুরে বেড়াতেন। বুধবার রাতে কোনো এক পর্যায়ে চলে যান ফজলুল হক হলে। মোবাইল ফোন চুরির কারণে সেই হলের বেশ কয়েকজন ছাত্র ছিল উত্তেজিত। তাকে দেখে জেরা করতে থাকে।