সংস্কার কমিশন বলছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ ইসিকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেবে। কমিশন বলছে, তারা আলাদাভাবে সরকারের কাছে সুপারিশ রাখবে। দুপক্ষই তাকিয়ে ঐকমত্য কমিশনের দিকে।
Published : 30 Jan 2025, 12:28 AM
ভোটার তালিকা আইন, সীমানা নির্ধারণ আইন, পর্যবেক্ষণ নীতিমালাসহ একগুচ্ছ আলোচ্যসূচি নিয়ে বৃহস্পতিবার তৃতীয় সভায় বসছে এএমএম নাসির উদ্দিনের নির্বাচন কমিশন।
আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে ইতোমধ্যে এ কমিশন ‘দ্বান্দ্বিক’ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে।
সংস্কার কমিশন তাদের মত সুপারিশ দিলেও ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করতে নিজেদের প্রয়োজনে ‘জরুরি’ সংস্কার নিয়ে সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের কাছে কিছু প্রস্তাব রাখবে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি। আর সেজন্য প্রধান উপদেষ্টা নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বুধবার বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝ বরাবর সংস্কার কমিশনগুলো রিপোর্ট দেবে।
তিনি বলেন, "রিফর্মের রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর কনসেন্সাস কমিশন কাজ করবে। রিফর্মের ওপর নির্ভর করবে ঠিক কবে ভোটটা হবে।"
তৃতীয় সভার আলোচ্যসূচিতে যা আছে
বৃহস্পতিবার সীমানা নির্ধারণ আইনসহ বেশ কয়েকটি আইন পর্যালোচনা করবে ইসি। আইন পর্যালোচনাসহ মোট ১১টি বিষয় রয়েছে আলোচ্যসূচিতে।
সিইসির সভাপতিত্বে এ সভায় চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব থাকবেন।
ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, কমিশনের তৃতীয় সভায় ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ পর্যালোচনা; জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০২১ পর্যালোচনা; নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা-২০২৩ এবং গাইডলাইনস ফর ইন্টারন্যাশনাল ইলেকশন অবজারভার অ্যান্ড ফরেন মিডিয়া পর্যালোচনা; নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ভাতার হার নির্ধারণ এবং প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষক নির্বাচন বিষয়ে পর্যালোচনাসহ বেশ কিছু বিষয় রয়েছে।
“সভার কার্যপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। এজেন্ডার বাইরে কোনো বিবিধ কি আলোচনা হতে পারে তা বলা যাচ্ছে না। তবে সংস্কার বিষয়ক তথ্য এজেন্ডায় নেই।”
আলোচ্যসূচিতে আরও রয়েছে-
>> বিভিন্ন দেশে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রমের শর্ত/পদ্ধতি/সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা।
>> নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক/গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য নীতিমালা পর্যালোচনা।
>> ডিআরএস সম্পর্কিত বিষয়াদি পর্যালোচনা।
>> ব্ল্যাঙ্ক কার্ড সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়াদি পর্যালোচনা।
>> প্রস্তাবিত জাতীয় নির্বাচনি পদক নীতিমালা, ২০২৫ এর উপর আলোচনা।
>> আইডিইএ দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের মেয়াদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা।
>> নির্বাচন কমিশনে বিদ্যমান প্যানেল আইনজীবী তালিকা হালনাগাদকরণ বিষয়ে আলোচনা এবং বিদ্যমান সম্মানী/ফি কাঠামো পর্যালোচনা।
>> বিবিধ।
ডিসেম্বরে ভোট করতে চাইলে অক্টোবরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে প্রস্তুতি শেষ করার মত রয়েছে ইসির।
সিইসি নাসির উদ্দিন বলেছেন, ভোটার নিবন্ধন ও সীমানা পুননির্ধারণ আইন, কানুন ‘ঠিক’ থাকলে কমিশন ভোটের প্রস্তুতিতে এগিয়ে থাকতে পারত।
রোববার নির্বাচন ভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আইন-কানুন, বিধি-বিধান দ্রুত ঠিক করে ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে গেলে অক্টোবরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।
“আমি সাইমালটিনিয়াসলি কাজ করতে চাই। আইন কানুন যদি ফিক্সড থাকত, ভোটার রেজিস্ট্রেশন, ডিলিমিটেশন, পার্টি রেজিস্ট্রেশন, অবজারভার নিয়োগ সমাধান, প্রকিউরমেন্ট শুরু করে ফেলতাম। আইন কানুনের জন্য সাইমালটিনিয়াসলি করতে পারছি না। জরুরি হয়ে পড়েছে আমার জন্য ডিলিমিটেশন করা; অতি দ্রুত আইনি বাধা দূর করতে হবে।”
ইসির ঐকান্তিকতার কোনো ‘অভাব নেই’ মন্তব্য করে সিইসি বলেন, “আমরা পাঁচ জন মুখে যা বলি তাই করি। মুনাফেকির মধ্যে নেই। একটা ফ্রি, ফেয়ার, ক্রেডিবল ইলেকশন করাই লক্ষ্য। …ঈদের দিনের মত উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই।”
এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেয় গত নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে। ২ ডিসেম্বর এ কমিশনের প্রথম সভায় হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। ২০ জানুয়ারি থেকে সে কাজ চলছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে একটি ধারণা দেন। এরপর স্থানীয় নির্বাচন না জাতীয় নির্বাচন কোনটি আগে হবে, তা নিয়ে সরব হয় নানা মহল।
১২ জানুয়ারি ইসির দ্বিতীয় কমিশন সভার পর জানানো হয়, জাতীয় নির্বাচনই হচ্ছে তাদের মূল ফোকাস। এরই মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনসহ চারটি কমিশন প্রতিবেদন দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে ১৫০টি সুপারিশ তুলে ধরেছে।
‘ভবিষ্যতের জন্য’ সুপারিশ
সীমানা নির্ধারণে আলাদা কর্তৃপক্ষ, এনআইডি ব্যবস্থাপনায় স্বতন্ত্র সংস্থা, সংসদীয় কমিটির কাছে ইসির জবাবদিহিতাসহ কয়েকটি বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আপত্তি রয়েছে সিইসি নাসির উদ্দিনের। তার ভাষায়, এসব সংস্কারে ইসির স্বাধীনতা ‘খর্ব হবে’।
বুধবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, “সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ, এনআইডি’র স্বতন্ত্র সংস্থা ও স্পিকারের নেতৃত্বে সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এটা নিয়ে এক ধরনের কনফিউশন তৈরি হয়েছে। বিদ্যমান আইনে যা আছে এখন তা থাকবে; তবে দীর্ঘমেয়াদের জন্য আমরা সুপারিশগুলো রেখেছি।”
পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেখলে ‘দ্বান্দ্বিক’ বিষয়টি কেটে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
সীমানা নির্ধারণ একটি ‘কারিগরি বিষয়’ মন্তব্য করে এ বিশ্লেষক বলেন, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ভুটানসহ অনেক দেশে এ ধরনের আলাদা সংস্থা চালু রয়েছে ।
শক্তিশালী কমিশন গঠনে নির্বাচনী আইনের কিছু বিষয়ে দ্রুত সংস্কারের সুপারিশের কথা তুলে ধরে আব্দুল আলীম বলেন, “নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে আরপিও তে কিছু সংস্কার সুপারিশ করেছি আমরা। এখন সার্বিক সুপারিশ নিয়ে একটি ভালো প্র্যাকটিসের কথা বিবেচনায় রেখে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ন্যাশনাল চার্টার করতে পারবে।”
এ সনদ আগামীতে নির্বাচন ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তি তৈরির পথ সুগম করবে বলে তিনি মনে করেন।
সরকারের কাছে সুপারিশ দেবে ইসি
নির্বাচনী আইনে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্রবাহিনী ও বিএনসিসিকে অন্তুর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেবে ইসি।
রোববার নির্বাচন ভবনে এক অনুষ্ঠানে এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, “আশা করি সরকার আমাদের প্রস্তাবে সায় দেবে। সরকারের কাছে শিগগির প্রস্তাব দেব, ল’ অ্যান্ড অর্ডার ফোর্সে সশস্ত্রবাহিনীকে ইনক্লুড করা, বিএনসিসিকে ইনক্লুড করা। তাহলে আমরা অ্যাডিশনাল টেন থাউজেন্ড ফোর্স (বিএনসিসি) পাব।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনেকগুলো সুপারিশ রয়েছে, যেগুলো গৃহীত হলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিইসি বলেন, “আইন কানুন এখনও ফিক্স হয়নি। রিফর্ম কমিশন সুপারিশ দিয়েছে। কোনগুলো গ্রহণযোগ্য হবে, কোনগুলো হবে না এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। ইসির জন্য রুল অব দি গেম কী হবে, নট ইয়েট ফিক্সড, বিকজ অব দি রিফর্মস কমিশন রিকমেন্ডেশন কাম ইন। চূড়ান্ত শেপ নিলে বলা যাবে অবস্থাটা কোন পযায়ে দাঁড়ায়।”
ইসিও তাকিয়ে ঐক্যমত্য কমিশনের দিকে
সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, “সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন কাজ করছে। আমরা আমাদের মতামত দেব। ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে পলিটিক্যাল পার্টি থাকবে। আমরা একটা বড় অংশীজন। আমাকে ইলেকশন করতে হবে, আমাকে মতামত দিতে হবে। আমরা কাজ করতে কোথায় সমস্যা, অসুবিধার কথা তুলে ধরছি। কোথায় গিয়ে কনসেসসাস হয়, ঐক্যমত্য কমিশনে কী হয়-সেটা তো এমন।”
সিইসির ভাষ্য, “রিফর্মস কমিশনের যখন রিপোর্ট আসছে, আমার মতামত না জানালে, চুপ করে যদি বসে থাকি; সব কিছু যদি একসেপ্ট হয়ে যায়; তখন তো বলবেন ‘তখন তো কিছু বললেন না’। আমার কনসার্ন রেকর্ড রাখতে হবে, এই এই ক্ষেত্রে অসুবিধা আমার হবে।”
তিনি বলেন, “রিফর্মস কমিশন হোক বা না হোক, আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে কিছু রিফর্ম করতে হবে। এগুলো নরমালি করতাম। আমাদের প্রয়োজনে যে রিফর্মস করা দরকার, আমরা সরকারের কাছে দেব, এটুকু চেইঞ্জ করেন। এখনও আশাবাদী, কনফিডেন্ট যে টাইমলাইন আমরা মিট করতে পারব। আমরা হোম ওয়ার্ক করে রাখছি, যাতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।”
পুরনো খবর
সংস্কার কমিশনের ৩ সুপারিশে সিইসির আপত্তি, বললেন স্বাধীনতা 'খর্ব হবে'
নির্বাচন সংস্কারে আইন-বিধি পর্যালোচনা করছে কমিশন
প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময় ধরে ভোটের প্রস্তুতি চলছে: ইসি সচিব
চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ২ মার্চ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য নেবে ইসি
আগে জাতীয় নির্বাচন করার পক্ষে ইসি
ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলে অক্টোবরের আগেই প্রস্তুত থাকতে হবে: সিই