’’আমাদের ব্যাংকিং খাত যে কতটা ভঙ্গুর হয়েছে এ খাত সংস্কারে কতটা সময় ও প্রচেষ্টা দিতে হচ্ছে এটা তার একটি নমুনা,” বলেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা।
Published : 13 Sep 2024, 12:02 AM
সুদ-আসল মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ৮৭৩ কোটি টাকা ফেরত দিতে পারছে না পদ্মা ব্যাংক, যা ২০৩৮ সালের আগেই আদায় করে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
একই সঙ্গে শুধু ধুঁকতে থাকা পদ্মা ব্যাংক নয়, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার আটকে থাকা অর্থ আদায়ে পথনকশা করার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এসব তথ্য তুলে ধরেন।
স্থায়ী আমানত হিসেবে পদ্মা ব্যাংকে (আগের ফারর্মাস ব্যাংক) ২০১৫ সালে জলবায়ু তহবিল ফান্ডের ৫০৮ কোটি টাকা জমা রাখা হয়েছিল। এতদিনে তা সুদ-আসলসহ বাড়ছে। তবে নানা ঋণ অনিয়মে টাকা বের হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকটি তা ফেরত দিতে পারছে না। বছর দুয়েক আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটি তা ফেরত দিতে ২০৩৮ সাল পর্যন্ত সময় চায়।
এদিন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিষদের বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন দুই উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান এবং যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এসময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পদ্মা ব্যাংকে জলবায়ু তহবিলে জমা রাখা অর্থ এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানায়।
রিজওয়ানা বলেন, ‘’আমার মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড বলে একটি ফান্ড রয়েছে। সেখানে তিন হাজার ৯৫১ কোটি টাকা সরকার দিয়েছিল। এরমধ্যে ৫৯৭ কোটি ৬২ লাখ ৫২ হাজার ২৫২ টাকা বিগত সরকার সাবেক ফারমার্স বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকে এফডিআর করে রেখেছিল। ওই ব্যাংকে যে টাকাটা রাখা হয়েছিল তা সুদে আসলে বেড়ে পাওনা হয়েছে ৮৭৩ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৩ টাকা। এই টাকাটা বার বার চাওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকটি দিতে পারছে না।
”তারা সরকারের সাথে কোনো আলোচনা না করেই নিজেরাই বছর বছর এই এফডিআরটা রিনিউ করছে। তাদের এখন বক্তব্য হচ্ছে ২০৩৮ সালের আগে এই টাকাটা আমাদেরকে দিতে পারবে না; না সুদ, না আসল।”
এরকম সমস্যা শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়সহ আরও অনেক জায়গায় থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেগুলো কী বিবেচনায় রাখা হয়েছে আমরা তো বলতে পারছি না।
”এ বিষয়টি আমরা উপদেষ্টা পরিষদে তুলেছিলাম। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নিয়ে এবং যেসব মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার অর্থ আটকে রয়েছে তাদের সাথে একসাথে বসে একটা রোডম্যাপ তৈরি করে দেবে, যাতে পাবলিক মানিটা ফেরত আসে। সরকারি কাজে লাগানো যায়।“
রিজওয়ানা বলেন, ’’আমাদের ব্যাংকিং খাত যে কতটা ভঙ্গুর হয়েছে এ খাত সংস্কারে কতটা সময় ও প্রচেষ্টা দিতে হচ্ছে এটা তার একটি নমুনা।’’
কতদিনের মধ্যে অর্থ আদায় করা হবে জানতে চাইলে এই উপদেষ্টা বলেন, ’’কবে পাওয়া যাবে জানলে তো আমরা খুবই খুশি হতাম আমরা তো সেটাই জানতে পারছি না। তবে খুব দ্রুতই মিটিংটা ডাকা হবে। কারণ একটা বড় অংকের সরকারি অর্থ আটকে রয়েছে। কাজেই মিটিংটা খুব দ্রুত হবে।
”তবে ব্যাংকগুলোর বাস্তব অবস্থা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তারা কত সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে পারবে। আমাদের ২০৩৮ এর আগে কত আগে কত অনুপাতে ফেরত আনা যাবে সেটা সেটা রোডম্যাপটা করা হলে বলা যাবে।”
পদ্মা ও ফারর্মাস দুই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আমলেই নানা ঋণ অনিয়মে ধুঁকছে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটি। ২০১৪ সালে সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের মালিকানায় যাত্রা করা ব্যাংকটির জলবায়ু তহবিলের অর্থ ফেরত দেওয়া নিয়ে আলোচনা অনেক দিনের।
এক বছর মেয়াদি স্থায়ী আমানতে সর্বোচ্চ সুদ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ২০১৫ সালে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ৫০৮ কোটি ১৩ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা জমা রাখা হয়। তবে তারা টাকা ফেরত দিতে পারেনি।
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত; পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।
আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটিতে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো মূলধন জোগান দেয়। মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য বেশকিছু নীতিছাড়ও দেওয়া হয়।
তবুও নাফিজ সরাফতের সময়ে ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং খেলাপি ঋণ আরও বাড়ে। সব আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না। এমন অবস্থায় জলবায়ু ফান্ডের অর্থ ফেরতে দিতে নাফিজ সরাফতের সময়ে ২০০২ সালে তা ফেরত দিতে ২০৩৮ সাল পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়।
পদ্মা ব্যাংকের দুর্দশা নিয়ে আলোচনার মধ্যে চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন নাফিজ সরাফাত।