“কোনো মানুষ তার ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের কারণে নিপীড়িত হবে না, এটা আমরা অবশ্যই নিশ্চিত করব,” বলেন তিনি।
Published : 02 Dec 2024, 11:54 PM
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ‘খারাপ’ অবস্থার মধ্যে আছে, বাংলাদেশকে এমনভাবে চিত্রায়নের দেশি-বিদেশি প্রচেষ্টা চলতে থাকার কথা কূটনীতিকদের বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তবে তারা যাতে সফল না হয় সে চেষ্টা চলতে থাকার কথাও কূটনীতিকদের অবহিত করেছেন তিনি।
সোমবার ঢাকায় বিদেশি মিশনগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরার বিষয়ে তিনি বলেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি এটা বলা ঠিক হবে না। বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। দুর্গাপূজার সময় দুয়েকটা ঘটনা ঘটেছে, প্রতিবছরই দুয়েকটা ঘটনা ঘটে।
“সেটা এই সরকার হোক বা অন্য কোনো সরকার হোক। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং যারা এ ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তাদের জন্য শাস্তি বিধান করা, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা। এই সরকার সেটা পুরোপুরি করেছে।”
এই অবস্থান থেকে কূটনীতিকদের ব্রিফ করার কথা তুলে ধরে পরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের বলেছি, বাংলাদেশ সাম্প্রয়িকভাবে একটা খারাপ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এ রকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির অভ্যন্তরীণ এবং দেশের বাইরের প্রচেষ্টা আছে। আমরা সেই প্রচেষ্টা যেন সফল না হয়, সেই চেষ্টা করছি।”
সোমবার বিকাল ৩টার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘পদ্মায়’ কূটনীতিকদের ব্রিফিং করা হয়। বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের এতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব রয়েছে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার ও জামিন না দেওয়ার ঘটনা নিয়ে দিল্লির উদ্বেগ প্রকাশ এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার কড়া ভাষায় জবাব দেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে।
চিন্ময় দাশকে চট্টগ্রামের আদালতে জামিন নামঞ্জুর করার দিন সনতানী ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে একজন আইনজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। সনাতনীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতেও বিক্ষোভ হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ওই বিফ্রিংয়ের পর সাংবাদিকদের সামনে আসেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, “গত কিছুদিনের বিশেষ করে হিন্দু সমাজের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের মনে হয়েছিল, যাতে কোনো ভুল ধারণার সৃষ্টি না হয়। কারণ ভুল ধারণা সৃষ্টি করার মত প্রচুর পরিবেশ আছে, বিশেষ করে গণমাধ্যমের একাংশ-কোন দেশের সেটা আমি বলছি না। তারা এটাকে যতটুকু পারা যায় একটা খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
“কাজেই আমাদের মনে হয়েছে যে, এখানে কূটনৈতিক সম্প্রদায় যারা আছে, বিষয়টাতে ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা প্রকৃত অবস্থাটা জানতে পারে। আমি জানি তাদের নিজেদেরও কিছু ম্যাকানিজম আছে তথ্য সংগ্রহের। কিন্তু আমাদের অবস্থানটা পরিষ্কার করার জন্য তাদের ডেকেছি।”
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি। আমি বলেছি, সাম্প্রয়িক সম্প্রীতি হচ্ছে সমাজের অংশ আর সরকার এটা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কোনো মানুষ তার ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের কারণে নিপীড়িত হবে না, এটা আমরা অবশ্যই নিশ্চিত করব।
“আমরা এটাও বলেছি, যে সরকার আছে, তারা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে প্রায় চার মাস সময়ে। যদিও মাল-মসলা ছিল অনেক বেশি গণ্ডগোল হওয়ার মত, সেটা কিন্তু আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি, সবার সহযোগিতায়। পরিস্থিতি বজায় রাখতে পেরেছি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ।”
বিফ্রিংয়ে ঢাকায় থাকা প্রায় সব মিশনের প্রধান বা প্রতিনিধি আসার কথা জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়েছি। তাদের বলেছি, এই বার্তা তাদের দেশে পৌঁছে দিতে।
“আমার মনে হয়েছে তারা (কূটনীতিকরা) কনফিউসড (বিভ্রান্ত)। এখন তারা বুঝতে পেরেছে, সহজে তারা এখন বলতে পারবে, ঘটনা কী হচ্ছে।”
ব্রিফিংয়ে আলাদা করে ভারতের বিষয়ে কিছু না বলার কথা তুলে ধরে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “তবে ভারতীয় গণমাধ্যমের কথা এসেছে। প্রধানত ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার।
“এর বাইরে ভারতীয় গণমাধ্যমের বক্তব্য ধরে অনেকে সেই লাইনে প্রচার করেছে। এ সরকার কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ বরদাশ করবে না এবং সেটা হিন্দু বলে কথা নয়, মুসলিম বলে কথা নয়; সবার ক্ষেত্রে সমান।”
তিনি বলেন, “এই বার্তাটা আমরা সবার ক্ষেত্রে দিতে চাই। আইন তার গতিতে চলবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হলে শক্ত হাতে দমন করা হবে। আমরা কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয়, আমাদের অবস্থান শক্তভাবে জানানোর জন্য কূটনীতিকদের ডেকেছি।”
কূটনীতিকদের ব্রিফিংয়ে আলাদা করে সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর বিষয় তুলে ধরার কথা জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “ইসকনের পুরোহিত চিন্ময়ের কথা ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করেছি। কী পরিস্থিতিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারপর কোর্ট তাকে জামিন দেয় নাই; তার সমর্থকদের অবস্থান। আমি বলেছি, এটা তারা (চিন্ময়ের সমর্থক) পেরেছে কারণ, তারা তাদের মত ব্যক্ত করার সুযোগ পেয়েছে। এ রকম ঘটনা তো আগে তারা করতে পারেনি।
প্রতিবাদ করতে কিছু ভারতীয় নাগরিকের বাংলাদেশে ‘প্রবেশের চেষ্টার’ বিষয়ে এক প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, “এটাকে আমি একটা উস্কানি হিসেবে দেখি। উস্কানি দেওয়ার মত লোকজন তো আছে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটাকে ততক্ষণ পর্যন্ত উস্কানি হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।”
এপিপিজি’র প্রতিবেদন ‘একপেশে’
ভারত সরকার এবং দেশটির সংবাদমাধ্যমের বিষয়ে সরকার বক্তব্য দিলেও গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ (এপিপিজি) ফর দ্য কমনওয়েলথের বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদন নিয়ে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যখন বৈঠক হবে, তখন বিষয়টি তুলে ধরবে ঢাকা। ওই প্রতিবেদনকে ‘অত্যন্ত একপেশে’ হিসেবে অভিহিত করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “চারটা নির্বাচনকে তারা মোটামুটি এক পর্যায়ে ফেলেছে। তিনবার পুননির্বাচিত হয়েছেন বলেছে, সেই নির্বাচনটা মান অনুযায়ী হয়েছে কি-না, সেটা নিয়ে একটা শব্দও সেখানে নেই।
“প্রায় পনেরশ’ ছেলেমেয়েকে হত্যা করা হয়েছে, একটা শব্দও উল্লেখ নাই সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দূতাবাসকে জানানো পর্যন্ত হয়নি, তারা এই কাজটা করছে।”
এপিপিজিতে টোরি পার্টির প্রভাব থাকার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, পূর্ববর্তী যে দল ক্ষমতায় ছিল তাদের লোকজনই বেশি। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তাদের প্রভাব একটু বেশি। এই প্রভাব বিস্তার তারা করতে পেরেছে।”
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘সংঘবদ্ধ ক্যাম্পেইন’ বিশ্বব্যাপী চলার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, “এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, এটা কিন্তু একটা গ্লোবাল ক্যাম্পেইন চলছে কিন্তু। গ্লোবাল ক্যাম্পেইনে সবাই অংশগ্রহণ করছে তা না, একটা গোষ্ঠী করছে, সব জায়গায় পৌঁছার চেষ্টা করছে তারা। গ্লোবালি যে করা হচ্ছে, এটা বলেছি আমরা।
“যারা এটা করছে, আমাদের তুলনায় তাদের পৌঁছার ক্ষমতা বেশি, এর মধ্যেও তাদেরকে মোকাবেলা আমাদের করতে হবে।”
আরও পড়ুন:
এমন মন্তব্য মমতার নিজের জন্যও ভালো না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠাতে কেন্দ্রের উদ্যোগ চান মমতা