দুদকের স্বাধীনতা কার্যকারিতার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রস্তাব করা হয়েছে, বলেন কমিশন প্রধান।
Published : 09 Feb 2025, 12:19 AM
ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সম্পর্কের কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ বন্ধ করতে এবং অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী মালিকানার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুটি আইন করার সুপারিশ এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে।
এছাড়া নির্বাচনী আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, আয়কর আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
শনিবার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি মন্ত্রি পরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, যেখানে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনের প্রার্থীদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা প্রতিষ্ঠা করার বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে।
এদিন রাষ্ট্র সংস্কারে প্রথম ধাপে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রথম ধাপে বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে ছয় কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
তার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। আট সদস্যের এই কমিশন গত ৩ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করে।
এর আগে ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দুদক সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। সেদিন প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপও সংবাদিকদের কাছে তুলে ধরা হয়।
কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুদক সংক্রান্ত আইন সংশোধন, দুদকের স্বাধীনতা কার্যকারিতার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রস্তাব করেছেন তারা।
“যেটা এখন ছিল না। শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে বাৎসরিক প্রতিবেদন দিতে হয়, যার বাস্তব কোন মূল্য নেই। দুদকের কমিশনার নিয়োগ যেন আরও স্বাধীন হয় সেটার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।”
নতুন আইন করার প্রস্তাব
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত স্বার্থ, পারিবারিক সম্পর্ক, পরিচিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে দায়িত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি প্রতিরোধে বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি ও আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। এর ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে।
সেজন্য কমিশন রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধ বিষয়ে আইন করার সুপারিশ করেছে।
এছাড়া বাংলাদেশে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির, বিশেষ করে- অর্থ পাচারের অন্যতম কারণ সুবিধাভোগী মালিকানার বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি কাঠামোও না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
তিন আইন সংশোধনের সুপারিশ
রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনের প্রার্থীদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানের স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে নির্বাচনী আইন সংস্কার করতে বলেছে কমিশন।
সংস্কারের মাধ্যমে যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে-
• রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনের প্রার্থীরা অর্থায়ন এবং আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য জনগণের সামনে উন্মুক্ত করবে।
• জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর ও দুদকের সহায়তায় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী হলফনামায় প্রার্থীদের দেওয়া তথ্যের পর্যাপ্ততা ও যথার্থতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
• সব পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মধ্যে ও পরবর্তীতে প্রতি বছর নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের আয় ও সম্পদ বিবরণী নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন এবং নির্বাচন কমিশন সেগুলো কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে।
• রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে দলীয় পদ বা নির্বাচনে মনোনয়ন দেবেন না।
বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে তিনজন নিয়ে কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। কমিশন আইন সংস্কার করে ন্যূনতম একজন নারীসহ তিন থেকে পাঁচজন কমিশনার করার সুপারিশ করেছে।
কমিশন গঠনে যে দুদক আইনে সার্চ কমিটির কথা বলা হয়েছে, আইন সংশোধন করে সেটি ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষক কমিটি’ করার সুপারিশ এসেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে যেন দুদক সব তথ্য বা দলিল চাওয়া মাত্রই পেতে পারে সেজন্য আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ৩০৯ সংশোধন করতে বলা হয়েছে।
চাকরি বিধিতে যে সংস্কার
দুদকের বিতর্কিত চাকরিবিধি ৫৪এর ২ ধারা বাতিল, সচিব পদ থেকে নিচের দিকের পদগুলোতে নিয়োগ-পদায়নে কমিশনের আইনের বড় পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
এর মধ্যে সচিব নিয়োগ, মহাপরিচালক পদে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা থেকে ৬০ শতাংশ পদায়ন ও পদোন্নতি, পরিচালক পদে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা ৭৫ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের চাকরি থেকে অপসারণ করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রসিকিউশন গঠন
দুদক আইনে স্বাধীন প্রসিকিউশনের কথা বলা থাকলেও সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার দুই দশকে তা হয়নি।
এ বিষয়ে সংস্কার কমিশন একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে, যেখানে ১০ থেকে ২০ শতাংশ নিজস্ব কর্মীর মাধ্যমে প্রসিকিউশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। পরে ক্রমান্বয়ে তা বাড়িয়ে নিজস্ব প্রসিকিউশন টিম গঠন করা হবে।
একইভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের যে পূর্বানুমতির বিধান করা হয়েছিল, সেটি পুরোপুরি বিলুপ্তি করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশনের কাজের পরিধি বাড়াতে ৩৬ জেলা কার্যালয়ের পরিবর্তে প্রতিটি জেলায় দুদকের কার্যালয় চালু করতে হবে।
এখন যে জেলা কার্যালয়গুলো আছে, সেগুলোতে বিশেষ জজ আদালত স্থাপন এবং ক্রমান্বয়ে জেলা কার্যালয় স্থাপন ও বিশেষ জজ আদালত গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশন গঠনের পর বাছাই কমিটি দেখবে দুদক কী করল, কোন মামলাগুলো কী কারণে নেওয়া হল, কী কারণে নেওয়া হল না। কমিশন ছয় মাস পর পর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। এই পর্যালোচনাগুলো নিয়ে পরে গণশুনানি হবে।
এছাড়া সুপারিশ করা হয়েছে দুদকে শৃঙ্খলা অনুবিভাগ রাখার।
এটির কাজ হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করা। কেউ যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত রাখার সুপারিশও করেছে কমিশন।
যাবাক সংস্কার ও অনুসন্ধান প্রথা বাতিল
দুদকের যাচাই বাছাই কমিটি (যাবাক) নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। তাই এই কমিটিও সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।
দুদকের জেলা বা বিভাগীয় কার্যালয়ের এই কমিটির সুপারিশ পুনরায় প্রধান কার্যালয়ের যাবাকের মাধ্যমে যাচাইবাছাই না করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে যাবাকে তিন সদস্যের মধ্যে একের অধিক প্রেষণে নিযুক্ত কর্মকর্তা না রাখার কথাও বলেছে সংস্কার কমিশন।
অন্যদিকে দুদকের তফসিলভুক্ত প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্তের আগে আবশ্যিক অনুসন্ধান ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এক্ষেত্রে লিখিতভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে অপরাধ সংঘটনের তথ্য পাওয়ার পর সরাসরি মামলা দায়ের করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করতে বলা হয়েছে সুপারিশে।
এর ফলে দুদকের কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা লাঘব হবে বলে মনে করছে সংস্কার কমিশন।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প (৬ মাস), মধ্যম (১৮ মাস) ও দীর্ঘমেয়াদি (৪৮ মাস) পথরেখার প্রস্তাবও করা হয়েছে।
পুরনো খবর:
দুদক সংস্কার: সার্চ কমিটির পরিবর্তে হবে 'বাছাই ও পর্যবেক্ষক কমিটি