দুদকে শৃঙ্খলা অনুবিভাগ রাখার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন, যার কাজ হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করা।
Published : 15 Jan 2025, 09:05 PM
দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করতে যে ৪৭ সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন, তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া এবং দুদকের নিজস্ব তহবিলের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পরে বিকালে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় কমিশনের অন্য সদস্যরাও সেখানে ছিলেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। একে কার্যকর ও গতিশীল করতে তিন সদস্যের কমিশনকে যথেষ্ট মনে করছে না সংস্কার কমিশন। তাই তিন সদস্যের পরিবর্তে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
“পাঁচ সদস্যের কমিশনে একজন নারী সদস্য যুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে দুদকের কাজের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন বিচারিক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো অভিজ্ঞদের যুক্ত করা এবং কমিশনের মেয়াদ পাঁচ থেকে কমিয়ে চার বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে।”
দুদকের নিজস্ব তহবিলের বিষয়ে সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকার অনুমোদিত বাৎসরিক বাজেটের অর্থ দুদকের তহবিলে জমা হবে। পাশাপাশি দুদকের মামলায় আদায়কৃত জরিমানা বা বাজেয়াপ্তকৃত অর্থের ন্যূনতম ১০ শতাংশ তহবিলে জমা হবে।
কমিশন গঠনে বাছাই কমিটি
কমিশন গঠনে যে দুদক আইনে সার্চ কমিটির কথা বলা হয়েছে, সেটি পরিবর্তন করে ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষক কমিটি’ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই কমিটি কমিশন বাছাই করে দেবে, সেই সঙ্গে কমিশন কী করছে তা ছয় মাস পর পর পর্যবেক্ষণ করবে। এটার জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিও প্রতিবেদনে সুপারিশ আকারে দিয়েছেন তারা।
দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা এড়াতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বাদ দিয়ে তারপরে যিনি সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ হবেন, তিনি হবেন বাছাই কমিটির প্রধান।
হাই কোর্টের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ একজন সদস্য হবেন, একজন থাকবেন প্রধান বিচারপতির নিযুক্ত, যিনি বাংলাদেশের শাসন সম্পর্কে জানেন। এছাড়া মহাহিসাব নিরীক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে একজন, সংসদ নেতা থেকে মনোনীত একজন সদস্য ও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা থেকে মনোনীত একজন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে বাছাই কমিটি।
কমিশন গঠনের বিষয়টি এতদিন গোপন থাকলেও এবার তা সবার জন্য উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
সংস্কার কমিশন তিনটি পদ্ধতির কথা সুপারিশ করেছে, একটি হলো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ‘শর্ত পূরণ’ সাপেক্ষে যে কেউ চাইলে কমিশনার হতে আবেদন করতে পারবেন বা ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষক’ কমিটি চাইলে বাছাই করে প্রার্থীর তালিকা তৈরি করতে পারবে। তৃতীয় হলো, কেউ চাইলে প্রার্থী মনোনীত করতে পারবেন।
প্রত্যেক প্রার্থীকে জীবনবৃত্তান্ত, পাশাপাশি দুদক সম্পর্কে তার জানাশোনা ও চিন্তাভাবনা কী, দুদক সম্পর্কে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রাথমিকভাবে তাদের তালিকা করা- এভাবে ন্যূনতম যোগ্যতার শর্ত যারা পূরণ করবেন, তাদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হবে।
প্রাথমিক তালিকা থেকে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে তিনজন করে ১৫ জন বাছাই করবে কমিটি। পরে এই নামগুলো প্রকাশ করা হবে। এক সপ্তাহ পর সেই তালিকা থেকে ১০ জনের নাম বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে দেবে। তবে সেই ১০ জনের নাম আর প্রকাশ করা হবে না। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন।
চাকরি বিধিতে যে সংস্কার
দুদকের বিতর্কিত চাকরিবিধি ৫৪এর ২ ধারা বাতিল, সচিব পদ থেকে নিচের দিকের পদগুলোতে নিয়োগ-পদায়নে কমিশনের আইনের বড় পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
এর মধ্যে সচিব নিয়োগ, মহাপরিচালক পদে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা থেকে ৬০ শতাংশ পদায়ন ও পদোন্নতি, পরিচালক পদে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা ৭৫ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের চাকরি থেকে অপসারণ করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রসিকিউশন গঠন
দুদক আইনে স্বাধীন প্রসিকিউশনের কথা বলা থাকলেও সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার দুই দশকে তা হয়নি।
এ বিষয়ে সংস্কার কমিশন একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে, যেখানে ১০ থেকে ২০ শতাংশ নিজস্ব কর্মীর মাধ্যমে প্রসিকিউশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। পরে ক্রমান্বয়ে তা বাড়িয়ে নিজস্ব প্রসিকিউশন টিম গঠন করা হবে।
একইভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের যে পূর্বানুমতির বিধান করা হয়েছিল, সেটি পুরোপুরি বিলুপ্তি করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশনের কাজের পরিধি বাড়াতে ৩৬ জেলা কার্যালয়ের পরিবর্তে প্রতিটি জেলায় দুদকের কার্যালয় চালু করতে হবে।
এখন যে জেলা কার্যালয়গুলো আছে, সেগুলোতে বিশেষ জজ আদালত স্থাপন এবং ক্রমান্বয়ে জেলা কার্যালয় স্থাপন ও বিশেষ জজ আদালত গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশন গঠনের পর বাছাই কমিটি দেখবে দুদক কী করল, কোন মামলাগুলো কী কারণে নেওয়া হলো, কী কারণে নেওয়া হলো না। কমিশন ছয় মাস পর পর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। এই পর্যালোচনাগুলো নিয়ে পড়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া সুপারিশ করা হয়েছে দুদকে শৃঙ্খলা অনুবিভাগ রাখার।
এটির কাজ হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করা। কেউ যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত রাখার সুপারিশও করেছে কমিশন।
যাবাক সংস্কার ও অনুসন্ধান প্রথা বাতিল
দুদকের যাচাই বাছাই কমিটি (যাবাক) নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। তাই এই কমিটিও সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।
দুদকের জেলা বা বিভাগীয় কার্যালয়ের এই কমিটির সুপারিশ পুনরায় প্রধান কার্যালয়ের যাবাকের মাধ্যমে যাচাইবাছাই না করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে যাবাকে তিন সদস্যের মধ্যে একের অধিক প্রেষণে নিযুক্ত কর্মকর্তা না রাখার কথাও বলেছে সংস্কার কমিশন।
অন্যদিকে দুদকের তফসিলভুক্ত প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্তের আগে আবশ্যিক অনুসন্ধান ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এক্ষেত্রে লিখিতভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে অপরাধ সংঘটনের তথ্য পাওয়ার পর সরাসরি মামলা দায়ের করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করতে বলা হয়েছে সুপারিশে।
এর ফলে দুদকের কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা লাঘব হবে বলে মনে করছে সংস্কার কমিশন।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প (৬ মাস), মধ্যম (১৮ মাস) ও দীর্ঘমেয়াদি (৪৮ মাস) পথরেখার প্রস্তাবও করা হয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রথম ধাপে বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে ছয় কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
তার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। আট সদস্যের এই কমিশন গত ৩ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করে।