আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. সাহাবুদ্দিন, তিনিই হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি

সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পুই হচ্ছেন বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি।

কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2023, 05:09 AM
Updated : 12 Feb 2023, 05:09 AM

বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দুদকের সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।

সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুই হচ্ছেন বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি।

রোববার সকালে দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নিজের সই করা মনোনয়নপত্র জমা দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ‘নির্বাচনী কর্তা’ কাজী হাবিবুল আউয়াল।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের নাম প্রস্তাব করেন, আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ তা সমর্থন করেন।

মনোনয়নপত্র জমার আনুষ্ঠানিকতা শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, "বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবউদ্দিন চপ্পুকে মনোনয়ন প্রদান করেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদীয় দলের নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন।”

আর সাংবাদিকদের একের পর এক অনুরোধের মধ্যে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু শুধু বলেন, “সবই আল্লাহর ইচ্ছা।”

এক নজরে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থীর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৪৯ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করা মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২০০৬ সালে তিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসরে যান।

ছাত্রজীবনে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। পরে সামলেছেন পাবনা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব। ১৯৭১ সালে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন চুপ্পু, মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করে সে সময় ক্ষমতাদখলকারীরা। সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকেও তখন কারাবরণ করতে হয়।  

পেশায় আইনজীবী সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে যোগ দেন। বিচারকের বিভিন্ন পদে চাকরি শেষে ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসর নেন।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়, যাতে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ওসব ঘটনার তদন্তে ‘কমিশন’ গঠন করে, যার প্রধান ছিলেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।

জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এই মহাসচিব বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয়ের নিযুক্ত করা সমন্বয়কারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান পদে তাকে মনোনীত করা হয়। দলের সর্বশেষ কাউন্সিলে তিনি নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এক ছেলের বাবা। তার স্ত্রী অধ্যাপক রেবেকা সুলতানা এক সময় যুগ্ম সচিব ছিলেন।

সাহাবুদ্দিন চুপ্পু রাজনীতি, বঙ্গবন্ধু এবং নীতি নির্ধারণী বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত কলামও লিখতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে।

বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২৩ এপ্রিল। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন, তা নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই নানা জল্পনা কল্পনা চলছিল।

এর মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এমনকি আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নামও সংবাদমাধ্যমে আসে।

মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে হবেন, তা ঠিক করার ভার দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে দিয়েছে তাদের সংসদীয় দল।

রোববার মনোনয়নপত্র জমার তারিখ থাকায় সকালেই গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতা। পরে তারা যান নির্বাচন কমিশনে। কিছুক্ষণ পর ইসিতে পৌঁছান আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সে সময় তাকে হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। 

এক নামে দুটি মনোনয়নপত্র

নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুটি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়েছে একই ব্যক্তির নামে।

“দুটি মনোনয়পত্রেরই প্রস্তাবক ও সমর্থক একই ব্যক্তি, একই নামে। যার নামে দাখিল হয়েছে তিনি মো. সাহাবুদ্দিন। পিতা মরহুম শরফুদ্দিন আনসারী। বাসা হোল্ডিং ৮৮/১ গ্রাম রাস্তা শিবরামপুর পাবনা। পোস্ট কোড ৬৬০০ পাবনা।”

ইসি সচিব জানান, মনোনয়নপত্রে প্রস্তাবকারীর নাম দেওয়া আছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী-৫ আসনের সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদের। এবং সমর্থনকারী হলেন চট্টগ্রাম-৭ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হাছান মাহমুদ।

সচিব জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচনী কর্তার দপ্তরে দুটি আবেদন সকাল ১১টা এবং সকাল ১১টা ৫ মিনিটে জমা দেওয়া হয়।

“এ দুটি আবেদন আগামীকাল (সোমবার) দুপুর ১টায় বাছাই করা হবে। বাছাইয়ে মনোনয়নপত্র বৈধ হলে আগামীকাল প্রধান নির্বাচনী কর্তা আপনাদের অবহিত করবেন।”

একক প্রার্থী হলে তার প্রক্রিয়া কী হবে জানতে চাইলে সচিব বলেন, “আগামীকাল বাছাইয়ের পরে বৈধ মনোনয়ন যেটা হবে, তার নাম ঘোষণা করা হবে। আইনানুগভাবে প্রত্যাহারের শেষ তারিখে আমরা চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করব কে বাংলাদেশের পরবর্তী মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তবে যেহেতু একই ব্যক্তির দুটো আবেদন করেছেন এবং দুটিই যদি বাছাইয়ে টেকে, তাহলে কালকেই এটা চূড়ান্ত হয়ে যাবে।”

নিয়ম ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, একই ব্যক্তি তিনটি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন, যেখানে প্রস্তাবক ও সমর্থক ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। একই পদে একাধিক প্রার্থী থাকলে তখন এক ব্যক্তি দুজনের প্রস্তাবক হতে পারে না।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী রোববার বিকাল ৪টা পর্যন্ত মনোনপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ আছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি যাচাই বাছাইয়ের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে।

রোববার আর কেউ প্রার্থী না হলে যাচাই বাছাই শেষে মো. সাহাবুদ্দিনকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। আর একাধিক প্রার্থী থাকলে সংসদের অধিবেশন কক্ষে ভোট হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে।

বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংসদে পরোক্ষ ভোটে। সংসদ সদস্যরাই এই নির্বাচনে ভোট দেন। ৩৫০ আসনের সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্য এখন ৩০৫।

অর্থাৎ, প্রার্থী একাধিক হলেও ভোটাভুটি হবে কেবল আনুষ্ঠানিকতা। টানা দুই বারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের উত্তরসূরি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনই বঙ্গভবনে যাবেন। 

স্বাধীনতার পর থেকে ২১ মেয়াদে এ পর্যন্ত ১৭ জন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের আইনে এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকতে পারেন।

বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে রয়েছেন। সেই হিসোবে নতুন রাষ্ট্রপতি হবেন এই পদে অষ্টদশ ব্যক্তি।

২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন আবদুল হামিদ। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মেয়াদ অবসানের কারণে রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হওয়ার ক্ষেত্রে মেয়াদপূর্তির তারিখের আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়।

সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর পর ১৯৯১ সালে একাধিক প্রার্থী হওয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একবারই সংসদের কক্ষে ভোট করতে হয়েছিল। পরে প্রতিবারই ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসছেন।