প্রায় দুই বছর বিএসএমএমএমইউ’র কেবিন ব্লকে ভর্তি দুই শিশু। এতদিনের কেবিন ভাড়া বাবদ ২২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করতে বলা হয়েছে তাদের। যদিও চিকিৎসার খরচ দেওয়ার ঘোষণা ছিল আগের সরকারের।
Published : 17 Nov 2024, 09:33 AM
মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো দুই শিশু নুহা-নাবা ব্যয়বহুল আর জটিল অস্ত্রোপচারের পর আলাদা হয় নয় মাস আগে; এখন অনেকটা সুস্থ হলেও তারা ফিরতে পারছে না বাড়িতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে গত ৭ নভেম্বর তাদের ছাড়া পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে বিল ধরেছে, তাতে নুহা-নাবার বাবা আলমগীর হোসেনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।
প্রায় দুই বছর বিএসএমএমএমইউ এর কেবিন ব্লকে ভর্তি দুই শিশু। সেই কেবিন ভাড়া বাবদ আলমগীরকে এখন ২২ লাখ টাকা বিল পরিশোধের কথা বলেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও দুই শিশুর চিকিৎসার খরচ দেওয়ার ঘোষণা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে।
গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর এখন বিলের বিষয়টি নিয়ে দপ্তরে দপ্তরে ঘুরছেন আলমগীর। কীভাবে কী করবেন, তা ভেবেও কূলকিনারা পাচ্ছেন না। বিল মওকুফ হবে কিনা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলছে না। উল্টো ‘মামলার ভয়’ দেখানোর অভিযোগ উঠেছে।
খরচ বহনের কথা ছিল সরকারের
২০২২ সালের ২১ মার্চ কুড়িগ্রাম জেলার কাঁঠালবাড়ীর পরিবহন শ্রমিক আলমগীর রানা ও তার স্ত্রী নাসরিনের ঘরে জন্ম নেয় মেরুদণ্ডে জোড়া লাগানো শিশু নুহা ও নাবা।
তাদের ঢাকায় আনা হয় ওই বছরের ৪ এপ্রিল। তখন থেকে ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএমএমইউ এর শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে ছিল। হাসপাতালের সার্জারি অনুষদের ডিন ও নিউরো স্পাইন সার্জন অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনের অধীনে দুই শিশুকে ভর্তি করা হয়। ৪ ডিসেম্বর তাদের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
এরপর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি তাদের প্রথম ধাপের সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর আরও কয়েক ধাপে অস্ত্রোপচার হয় এই দুই শিশুর। চূড়ান্তভাবে আলাদা করা হয় ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি।
বিএসএমএমইউর সার্জারি অনুষদের সে সময়ের ডিন ও নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে ৩৯ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ১০০ জনের দল এতে অংশ নেয়। চিকিৎসক দলে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনও ছিলেন। ১৫ ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচার শেষে নুহা ও নাবা আলাদা হয়।
দুই শিশুকে আলাদা করার পর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “শিশু দুটির চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি উপাচার্য মহোদয়কে বলেছেন, দুটি শিশুর চিকিৎসার যা খরচ, তিনি বহন করবেন।”
প্রধানমন্ত্রী শিশুদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছিলেন বিএসএমএমইউ’র তখনকার উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। এতদিন সব খরচও বিশ্ববিদ্যালয় বহন করে এসেছে।
কিন্তু এখন বিল নিয়ে নুহা-নাবার বাবা আলমগীর হোসেন বলছেন, এত টাকা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। বিষয়টি কীভাবে নিষ্পত্তি হবে, তা জানতে বিভিন্ন বিভাগে ঘুরছেন, কেউ কিছু বলছে না।
‘এ দপ্তর না ও দপ্তর’
আলমগীর বলেন, গত ৭ নভেম্বর নুহা-নাবাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা। ৫ নভেম্বর বিএসএমএমইউ এর ‘রেন্ট কালেক্টর’ অফিস থেকে তাকে জানানো হয়, ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৭০৫ দিন কেবিন ব্যবহার করেছেন তারা। দৈনিক ৩ হাজার ১০০ টাকা হিসেবে ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া হয়েছে। ছাড়পত্র নিতে এটি নিষ্পত্তি করতে হবে।
আলমগীর হোসেন বলেন, রেন্ট কালেক্টর অফিস থেকে বলা হয়েছে বিল নিয়ে কী হবে, সে ব্যাপারে পরিচালকের (হাসপাতাল) সঙ্গে কথা বলতে হবে। পরে তিনি পরিচালকের কার্যালয় যান। কাগজপত্র পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে রেখে আসেন। তবে ৬ নভেম্বর তাকে ডেকে নিয়ে কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, “৭ নভেম্বর অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করি। সেসময় আমাকে বলা হয় বিষয়টি মানবিক। হাসপাতাল শাখা থেকে ফাইল এলে তারা বিষয়টি দেখবেন। আর ফ্রি করে দেওয়া হবে কিনা, সেটি ভিসি অফিস দেখবে।
“সেদিন আমি ফের পরিচালক (হাসপাতাল) স্যারের অফিসে যাই। সেসময় পরিচালক স্যারের ব্যক্তিগত সহকারী আমাকে সেখানে ঢুকতে দেয়নি। তিনি বলেন কাগজপত্র অর্থ ও হিসাব বিভাগে জমা দিতে।”
সেদিনই আলমগীর কাগজপত্র অর্থ ও হিসাব বিভাগে জমা দেন। তবে ৯ নভেম্বর ওই বিভাগ থেকে ডেকে পাঠিয়ে কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হয়।
তার ভাষ্য, “পরিচালক স্যার (অর্থ ও হিসাব) আমাকে ভিসি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সে অনুযায়ী সেদিনই আমি ভিসি স্যারের পিএস-২ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলি। তিনি ভিসি স্যারের পিএর কাছে আবেদন জমা দিতে বলেন। সেখানে গেলে তারা বলেন, আবেদন পরিচালক হাসপাতাল হয়ে আসতে হবে।
“বিষয়টি আমি ভিসির পিএসকে বুঝিয়ে বললে তিনি ৯ নভেম্বর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি ভিসির সুপারিশ নিয়ে দেবেন বলেন। তবে ৯ নভেম্বর ও ১০ নভেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সাইফুল ইসলামের দেখা পাইনি।”
আলমগীর বলেন, ১১ নভেম্বর পিএস সাইফুলের সাক্ষাৎ পান। তবে সেদিন সাইফুল তাকে বলেন, তার নামে ‘মামলা হবে’।
“১১ নভেম্বর ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে উনার দেখা পাই। পিএস স্যার বলেন, ‘আপনার বিষয়গুলো নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। ভিসি স্যার এই বিষয়ে কিছু করতে পারবে না। আপনার কপালে খারাপ আছে। আপনার নামে মামলা হতে পারে’।”
নুহা-নাবার বাবা জানান, এরপর থেকে কারও সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও যোগাযোগ করা হয়নি।
কী হবে নুহা-নাবাদের
নুহা-নাবাদের বিষয়টি কীভাবে নিষ্পত্তি হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি বিএসএমএমইউ প্রশাসন থেকে।
বিএসএমএমইউ হাসপাতাল পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) গৌর মিত্র বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকদিন আগে রেন্ট কালেক্টর একটা ফাইল নিয়ে আসছিল। তখন তারা বলছিল যে ওদের কেবিনের ভাড়া। এই ফাইল অনুমোদনের ক্ষমতা ভাইস চ্যান্সেলরের। তিনি প্রশাসনের পরামর্শে একটা করতে পারেন। যতদূর জানি এটাকে ‘ল্যাবরেটরি কেইস’ হিসেবে করে দেওয়া হবে।”
বিএসএমএমইউর পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রেজাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই শিশুকে আলাদা করার কাজটি শুরু করেছিলেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন; উনারা প্রফেশনাল দিক দেখেছেন। আর যারা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ দিক দেখেছেন, তারাও পজেটিভ ছিলেন। হয়ত এখানে সামান্য গ্যাপ রয়ে গেছে।
“সেসময় একটা অফিস আদেশ হয়ে গেলে এত কিছু ঘটত না। এটা সরাসরি আমার পার্ট না, আর্থিক বিষয় আমি ডিল করি না, আমার এখতিয়ারও নাই।”
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিষয়টি আগের প্রশাসনের, তারা কোন প্রক্রিয়ায় কাজটি করেছে, তা তার জানা নেই।
“পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের কেউ আমার সঙ্গে আলাপ করেনি। আমাকে কেউ বলেওনি। যদি প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে তাহলে জানতে পারব। তারা যদি বসে, যদি বলে যে এই প্রবলেম, তখন আমরা কথা বলতে পারব। কিন্তু আমাদের কিছু জানায়নি।”
বিষয়টি নিয়ে শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম জাহিদ হোসেন শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিশু দুটির বিষয়ে আমাদের বিভাগে আর কোনো ইস্যু নেই। আমাদের এখান থেকে শিশু দুটিকে আমরা ছুটি লিখে দিয়েছি। এখন তারা কেন যাচ্ছে না বলতে পারব না।”
এর আগে গত ৩১ অক্টোবর জাহিদ হোসেন বলেছিলেন, শিশু নুহা-নাবাকে ছুটি দেওয়ার প্রক্রিয়া করছেন তারা।
নুহা-নাবার পরবর্তী চিকিৎসার খরচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে কিনা, সেই প্রশ্নে তখন তিনি বলেন, “খরচের বিষয়টি আমি জানি না। এতদিন তো ইউনিভার্সিটি প্রশাসন তাদের চিকিৎসার খরচ দিয়েছে। হয়ত পরের ধাপের চিকিৎসার খরচও ইউনিভার্সিটিই দেবে। আমি জাস্ট চিকিৎসা করব, খরচের বিষয়টি প্রশাসন জানবে।”
নুহা ও নাবা আলাদা হলেও পরবর্তীতে তাদের আরও একটি অস্ত্রোপচার করতে হবে। তাদের পরবর্তী চিকিৎসার ব্যয়ের বিষয়ে বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য সায়েদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “ওই শিশু দুটির পরবর্তী অস্ত্রোপচারের খরচও বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে।”
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক শাহীনুল আলম বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়টা আমি জানি না। আমি অ্যাকাডেমিক দিকটা দেখি। প্রো-ভিসি অ্যাডমিন হয়ত বলতে পারবেন। আমাকে বলতে হলে শনিবার খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব।”
তবে শাহীনুল আলমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
পুরনো খবর-
আলাদা নুহা-নাবা: ধীরে ধীরে ফিরছে স্বাভাবিক জীবনে