আলাদা হবে নুহা ও নুবা, প্রস্তুতিতে চিকিৎসকরা

মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো শিশুকে এই প্রথম আলাদা করবে বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2022, 02:51 PM
Updated : 1 Dec 2022, 02:51 PM

আট মাস বয়সী ফুটফুটে দুই বোন নুহা ও নুবা, জন্ম থেকেই তাদের পিঠের নিম্নাংশ জোড়া লাগানো; ফলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করতে হবে তাদের।

সেই প্রক্রিয়াই শুরু করেছেন দেশে চিকিৎসা শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকরা।

কুড়িগ্রামে জন্ম নেওয়া শিশু দুটি জন্মের প্রায় পর থেকেই সেই হাসপাতালে ভর্তি আছে। অস্ত্রোপচারের জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সেই বোর্ড সভাও করেছে।

জোড় জমজ আগে আলাদা করলেও এই প্রথম মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো মানব শরীরকে আলাদা করার উদ্যোগ নিয়েছেন বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা। এমন অস্ত্রোপচার শুধু জটিলই নয়, সময়সাপেক্ষও বলেছেন তারা।

বৃহস্পতিবার বোর্ড সভা শেষে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক মো. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, “শিশু দুইটির পিঠে জোড়া লাগানো। এটা সারাতে কয়েকদফা অস্ত্রোপচার করতে হবে।”

প্রথম অস্ত্রোপচার আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হবে বলে জানান তিনি।

কতটা জটিল?

বিএসএমএমইউর মেডিকেল বোর্ডের প্রধান নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক এবং সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন এই অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেবেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিশু দুটির স্পাইনাল কর্ড একসঙ্গে জোড়া লাগানো আছে। তাছাড়া তাদের পায়ুপথ একটা, মূত্রনালী দুটো হলেও যৌনাঙ্গ একটা। হৃদযন্ত্রেও ছিদ্র আছে।

“স্পাইনাল কর্ডের জোড়াটাই একটু বেশি জটিল, এছাড়া তাদের জন্মগত ত্রুটিও আছে। ফলে এই সার্জারিটা একবারে করা যাবে না। আস্তে আস্তে অপারেশনগুলো করতে হবে। নিউরোসার্জন, ইউরোলজিস্ট, শিশু সার্জন, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন, এনেস্থিওলজিস্ট, শিশু পুষ্টিবিদসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকের প্রয়োজন হবে। প্রায় বছরখানেক সময় লেগে যাবে।”

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সিটিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা.সামন্ত লালও রয়েছেন মেডিকেল বোর্ডে। তিনি বলেন, “শিশু দুটির কেস স্টাডি দেখে বুঝতে পারলাম, তাদের অপারেশন অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এ অপারেশন বেশ কয়েক ধাপে করতে হবে।”

কুড়িগ্রামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নুহা ও নাবার জন্ম। কুড়িগ্রামের চিকিৎসকদের একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গিয়ে শিশু দুটির কথা জানতে পারেন ডা. হান্নান।

তিনি বলেন, “একজন চিকিৎসক ওই দুই শিশুর কথা জানালে আমি দেখতে যাই। শিশুর অভিভাবকরা তাদের বাচ্চা দুটির চিকিৎসা দিতে অনুরোধ করেন। আমি তখন বললাম, তাদের বিএসএমএমইউতে নিয়ে আসেন। এখানে আসার পর নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তি করে নেওয়া হয়েছে।”

এ বছরের ২১ শে মার্চ শিশু দুটির জন্ম। ডা. হান্নানের কথায় কয়েকদিন পরই শিশু দুটিকে নিয়ে ঢাকায় এসে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করান তাদের বাবা-মা।

শুনতে হয়েছিল নানা কথা, পোহাতে হচ্ছে আর্থিক সঙ্কট

নুহা ও নুবার বাবা আলমগীর রানা কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি পরিবহন কোম্পানির কাউন্টার ম্যানেজার, মা নাসরিন গৃহিনী। তাদের প্রথম সন্তান ছেলে। এরপরই জন্ম হয় নুহা ও নুবার।

আলমগীর রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সন্তান হওয়ার পর পরিচিত অনেকেই নানা নেতিবাচক কথা বলেছেন।

“দুইএকজন উপহাসও করছিল। অনেকে বলছে, আল্লাহ দিছে, কী করা যাবে, ঠিক হয়ে যাবে।”

কারও কারও কাছ থেকে সাহস পাওয়ার কথাও বলেন রানা।

নুহা-নুবার জন্মের কিছুদিন পর থেকে আট মাস ধরেই স্ত্রীকে নিয়ে বিএসএমএমইউতে আছেন রানা। এ কারণে চাকরিটা চলে গেছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের পাশাপাশি বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরাও তাদের কিছু সহায়তা করছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার কারণে সবাই পরিচিত হয়ে গেছে।

রানা বলেন, “জমানো কিছু টাকা-পয়সা ছিল, কিছু জিনিসপত্র বিক্রি করছি। বন্ধুরা কিছু ধার দিছে, এভাবেই চলতেছিলাম। এক পর্যায়ে টাকা শেয় হইয়া গেলে আমাদের যে স্যার নিয়া আসছিলেন, তাকে বলার পর বাচ্চাদের দুধের খরচটা দিচ্ছেন। বাকি খরচটা আমরাই কষ্ট করে চালাচ্ছি।”

তবে অস্ত্রোপচারসহ চিকিৎসা খরচ নিয়ে রানার দুর্ভাবনা লাঘব করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দুই শিশুর চিকিৎসায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে জানিয়ে অধ্যাপক  শরফুদ্দিন জানান, প্রধানমন্ত্রী তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন।