‘সব সাজানো নাটক’: গ্রেনেড হামলার বিচার নিয়ে ফখরুল

বিএনপি নেতা বলেন, “এটা ডেফিনেটলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম জঘন্য একটি ঘটনা এবং নিন্দনীয়। কিন্তু নেতাদের নাম দিয়ে সেখানে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা হচ্ছে।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2023, 10:08 AM
Updated : 21 August 2023, 10:08 AM

বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার তদন্ত ও বিচারকে, ‘সাজানো নাটক’ বলেছেন বিরোধী দলটির নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি বলেও অভিযোগ তার দাবি, তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হামলার সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টু, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদসহ যাদের সাজা হয়েছে তারা সবাই ‘নির্দোষ’। তাদেরকে রাজনৈতিক কারণে ফাঁসানো হয়েছে।

হামলার ১৯ তম বার্ষিকীতে সোমবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যখন নানা আয়োজনে দিবসটি স্মরণ করছে, সে সময় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে বিএনপি নেতা এ কথা বলেন।

আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি ঠিক করতে দল ও অঙ্গসংগঠনকে নিয়ে যৌথ সভায় বসেন বিএনপি মহাসচিব। পরে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে এলে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

গ্রেনেড হামলা নিয়ে এক প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, “বিচার কার্যক্রম তো শেষই করে ফেলেছে। কী বাকি আছে আর? ব্যাপার হচ্ছে যে, পুরো বিষয়টাই (বিচার প্রক্রিয়া) একেবারে আমি বলব যে, একটা সাজানো নাটক।”

এই মন্তব্যের পেছনে কী ব্যাখ্যা, তা তুলে ধরে বিএনপি নেতা বলেন, “কারণ, যেখানে মিটিং হওয়ার কথা ছিল, সেখানে মিটিং না হয়ে অন্য জায়গায় মিটিং শিফট করা হল… এটা দেখভাল করার জন্য যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি, তাদেরকে সেটা ইনফার্ম করা হয়নি।

“তারেক রহমানের নাম এফআইআর (এজাহার)-এ ছিলই না, কখনই ছিল না। তিনবার এফআইআর হয়েছে। তার মধ্যে একবারও তার ছিল না।

“এরপরে একজন ব্যক্তি যিনি আগে রিটায়ার্ড করেছেন, কাহহার আখন্দ, যিনি আওয়ামী লীগের নমিনেশন চেয়েছিলেন, তাকে নিয়ে এসে পুনরায় চাকরি দিয়ে তাকে এই মামলার আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) করা হল। সেই ভদ্রলোক তখন তারেক রহমানের নাম সেখানে দিলেন।”

তিনি বলেন, “তারেক রহমানের কোথাও উচ্চারিত হয়নি পুরো তদন্তে । একমাত্র মুফতি হান্নানকে দিয়ে বলানো হয়েছিল প্রায় ১৪৫ দিন রিমান্ডে নেওয়ার পরে। তিনি আবার সেটাকে কিন্তু অস্বীকার করে এফিডিভেট দিয়েছিলেন। সেটাকে গ্রহণ করা হয়নি।”

এই মামলার আসামি মুফতি আবদুল হান্নানকে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দেওয়ার অভিযোগও করেন বিএনপি মহাসচিব।

২১ অগাস্টে গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আসার প্রায় দেড় বছর আগে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর করা হয় মুফতি হান্নানের।

২০০৪ সালেই সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় এই সাজা কার্যকর করা হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, “তড়িঘড়ি করে যাতে সে (মুফতি হান্নান) কোর্টে গিয়ে কিছু বলতে না পারে অন্য একটা কেইসে ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। তাকে ইতিমধ্যে ফাঁসি কার্যকর করে তাকে আর কোর্টে আসার সুযোগই দেওয়া হল না। তাহলে এটাকে আমরা কী বলব?”

তিনি আরও বলেন, “এটাই নয় শুধু, আমার কাছে রেকর্ডস আছে। আমি সময় পেলে আমি আপনাদের দেখাব যে, এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তারেক রহমানের নাম এখানে (এই মামলা) দেওয়া হয়েছে, বিএনপির নেতাদের নাম এখানে দেওয়া হয়েছে। কোনো সুষ্ঠু তদন্ত না করেই এই কাজটা করা হয়েছে।” 

হামলার পর জোট সরকারের আমলে যা যা হয়

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়। 

আরও পড়ুন: ২১ অগাস্ট: কর্মীদের মানবঢালে যেভাবে প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা

এই হামলার পর এর তদন্ত নিয়ে নানা ঘটনা ঘটেছে। অবিস্ফোরিত গ্রেনেডের আলামত নষ্ট করে ফেলা, বিদেশি তদন্ত সংস্থাকে এনে সহযোগিতা না করা, মূল অপরাধীদেরকে আড়াল করতে জজ মিয়া নামে নির্দোষ একজনকে ফাঁসানোর চেষ্টা গণমাধ্যমে পরে ফাঁস হয়।

সে সময় তাকে নিয়ে বলানো হয়, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।

তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকাশ পায়, পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি প্রতি মাসে টাকা দেওয়ার বিনিময়ে জজ মিয়াকে এই স্বীকারোক্তি দিতে প্ররোচিত করে। পরে তাকে অব্যাহতি দিলে ২০০৯ সালে তিনি মুক্তি পান।

আরও পড়ুন: তারা ফ্যানে ঝুলিয়ে পায়ে পেটাত: জজ মিয়া

হাই কোর্টের বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি বিচারিক তদন্তও করা হয়। এতে দাবি করা হয়,

হামলার এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ ‘সন্দেহাতীতভাবে’ ইঙ্গিত করে, গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল।

এমনও বলা হয়, প্রতিবেশী একটি দেশে লোহার খাঁচা বানিয়ে গ্রেনেড হামলার অনুশীলন করা হয়।

বলা হয়, অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল।

সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বলেছিলেন, “শেখ হাসিনা তার ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন।” 

এই হামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের দাবি পর্যন্ত জানান প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তারেক রহমান। 

পুনঃতদন্তে যেভাবে আসামি বিএনপি নেতারা

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে মামলাটি নতুন করে তদন্ত হয়। সে সময় গ্রেপ্তার হন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টু। তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনকেও আসামি করা হয়। ওই সময় জানা যায়, তাজউদ্দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় দেশ ছাড়েন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।

এতে বিএনপি নেতা বাবর, আবদুস সালাম পিণ্টু, তার ভাই তাজউদ্দিন, জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারও শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এলে মামলাটি আবার তদন্ত করা হয়। এবার আসামি হিসেবে তারেক রহমান ছাড়াও যোগ হয় মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ কয়েকজনের নাম। 

কী সাজা, কাদের সাজা

১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ মামলার রায় দেয় ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এ ছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়।

তবে হাই কোর্টে এখনও মামলাটি শেষ হয়নি। এখনও পেপার বুক পড়াই বাকি আছে।

হাই কোর্টের এই রায়ের পর আবার আপিল বিভাগে শুনানি হবে। এরপর রিভিউ ও রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন শেষে কার্যকর হবে শাস্তি।

আরও পড়ুন:

২১ অগাস্ট: বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, তারেকের যাবজ্জীবন

২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার ১৯ বছর: হাই কোর্টে বিচার শেষের অপেক্ষা

‘হামলার ঘটনা নিন্দনীয়, কিন্তু…’

মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা বার বার বলে এসেছি যে একটা নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তদন্ত হোক। সেই নিরপেক্ষ তদন্ত করা হয়নি। আমরা ২১ আগস্টের ঘটনাকে কনডেম (নিন্দা) করি। এটা ডেফিনেটলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম জঘন্য একটি ঘটনা এবং নিন্দনীয়।”

তিনি বলেন, “কিন্তু একই সঙ্গে সমগ্র মানুষের যে প্রত্যাশা সেটা হচ্ছে যে… এটা অযথা শুধু রাজনৈতিক কারণে নেতাদের নাম দিয়ে সেখানে রাজনৈতিক ফয়দা লোটা হচ্ছে… এটা কেউ সমর্থন করতে পারে না।

আরও পড়ুন: গ্রেনেড হামলা মামলার আগের তদন্তই ঠিক: রিজভী

“আমরা আবারো বলছি, তারেক রহমান সাহেব, বিএনপির আবদুস সালাম পিন্টু বা লুৎফুজ্জামান বাবর, তারা কেউ এটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে জড়িত করা হয়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, মজিবুর রহমান সারোয়ার, আবদুস সালাম আজাদ, মীর সরাফত আলী সপু, মনির হোসেন, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারি ছিলেন।

সহযোগী সংগঠনের মধ্যে যুব দলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানি, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, মহিলা দলের সুলতানা আহমেদ, হেলেন জেরিন খান, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, উলামা দলের শাহ নেসারুল হক, জাসাসের হেলাল খান, জাকির হোসেন রোকন, মতস্যজীবী দলের আব্দুর রহিম, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ, মজিবুর রহমান, শ্রমিক দলের মঞ্জরুল ইসলাম মঞ্জু, ছাত্র দলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব উপস্থিত ছিলেন।