“আক্ষেপ তো একটাই, যে সর্বস্তরের বাংলা চালু কর- এ স্লোগানটা কার্যকর হল না,” ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্তিতে দেওয়া একান্ত এক সাক্ষাৎকারে এই আক্ষেপ ঝরল।
Published : 22 Feb 2023, 12:46 AM
বয়স ৯৩ বছর হল, তবে বাহান্নর স্মৃতি এখনও ঝকঝকে আহমদ রফিকের মনে; বাঙালির বড় এই অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম।
ঠিক ৭১ বছর আগে পাকিস্তান আমলে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় যখন প্রাণবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি।
ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্তিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত এক সাক্ষাৎকারে বাহান্নর স্মৃতির বেদিতে যেন হাঁটলেন নবতিপর আহমদ রফিক।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল বাঙালি, তার পথ ধরে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে স্বাধীনতা।
তবে একটি বিষয় নিয়ে এখনও আক্ষেপ বয়ে বেড়াচ্ছেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক; তা হল সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হওয়া।
তিনি বলেন, ভাষা সংগ্রামীদের তিনটি স্লোগান ছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু কর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান ছিল এটাই-জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।
“এটা বহু পোস্টারে লেখা হয়েছিল। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু করার মানেটা দাঁড়াল-শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালতসহ সর্বত্র বাংলা, বাংলা মাধ্যম চালু করা। আক্ষেপ তো একটাই, যে সর্বস্তরের বাংলা চালু কর- এ স্লোগানটা কার্যকর হল না।”
দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদান হলেও শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধারা পীড়া দেয় আহমদ রফিককে।
“শিক্ষার্থী শ্রেণীকে দুটো ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে-বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা। আমি বলি, সবাই সমান হোক, ইংরেজি মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আন।”
আহমদ রফিকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের শাহবাজপুরে। মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর রসায়নে পড়তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ফজলুল হক হলের আবাসিক সুবিধা না পাওয়ায় ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ১৯৫২ সালে তৃতীয়বর্ষে পড়ার সময় ফজলুল হক হল, ঢাকা হল এবং মিটফোর্ডের ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলার কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি সভা-সমাবেশ মিছিলে ছিলেন নিয়মিত। ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আন্দোলনকারী ছাত্রদের মাঝে একমাত্র তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়। ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে প্রকাশ্যে এসে বেরিয়ে পড়াশোনায় ফেরেন আহমদ রফিক। এমবিবিএস ডিগ্রি নিলেও সেই চিকিৎসকের পেশায় যাননি। ১৯৫৮ সালেই, আহমেদ রফিকের প্রথম প্রবন্ধের বই ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’ প্রকাশ হয়। তারপর লেখালেখিতেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, রবীন্দ্রত্ত্বাচার্য উপাধিসহ অনেক সম্মাননা।
ঢাকার ইস্কাটনে বাহান্নর সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলার সময় নানা প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন আহমদ রফিক, বলেছেন তখনকার মজার সব স্মৃতি।
‘নায়ক ছাত্ররা’
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হলেও আন্দোলনে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরই এগিয়ে রাখছেন আহমদ রফিক।
তার ভাষায়, “আমি বরাবরই বলি, সাধারণ ছাত্ররাই আন্দোলনটা করেছে। নেতারা নয়, সাধারণ ছাত্ররাই এ আন্দোলনের নায়ক।”
তিনি বলেন, আন্দোলনটা ছাত্ররা শুরু করেছে, জনসাধারণ এমনকি শ্রমিকরা তাতে যোগ দিয়েছে। এটা যদি না হত, তাহলে দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলন বিস্তৃত লাভ করতে পারত না।
যেভাবে পুরোদেশে বিস্তৃত হয়েছিল তার তুলে ধরে এ ভাষাসংগ্রামী বলেন, পাবনার চাটমোহর, কোথায় গাইবান্ধা, পশ্চিমে কোথায় মেহেরপুর, সবখানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনটাকে গ্রাম পযন্ত নিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
“এজন্য বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এতটা জোরদার, এতটা জনমুখী, এতটা বিস্তৃত, এতটা গ্রামমুখী, এতটা বিদ্যালয়মুখী। স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়-এ ছাত্ররাই কিন্তু এর প্রধান কারিগর। ভাষা আন্দোলন ছাত্রদের বহুমুখী বহু প্রতিভার দান। তারা শুরু করেছে, জনসাধারণ এটা তুলে দিয়েছেন।”
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের ভাষা আন্দোলনের অবদানও উপেক্ষা করার মতো নয় বলে মনে করেন আহমদ রফিক।
তিনি বলেন, তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা ছিল শুধু ১৯৪৭-৪৮ সালে। তাদের সাংগঠনিক প্রয়োজনে অর্থাৎ আর্দশ-চিন্তাভাবনার বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র বানানোর উদ্দেশ্য ছিল। তারা চেয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেই এ কাজটা সহজেই করতে পারবে।
“তাদের ভূমিকাটা উদ্দেশ্যমূলক। প্রগতিশীলদের উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা। তবুও তমুদ্দুন মজলিস বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেছে, সেলক্ষ্যে সংগঠন তৈরি করেছে। সেজন্য তাদের কৃতিত্ব প্রাপ্য, তা অস্বীকার করি না,” বলেন সমাজতন্ত্রকে মূল মন্ত্র মানা আহমদ রফিক।
‘ভালো চিকিৎসা পেলে বেঁচে যেত’
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার দাবিতে রাজপথে নেমে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন যারা, সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে তাদের বাঁচানো সম্ভবপর হত বলে মনে করেন তখনকার মেডিকেলের ছাত্র আহমদ রফিক।
সালাম, রফিক, জব্বারের মৃত্যু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস্থা যদি ভালো থাকত, স্টান্ডার্ড মান যদি উন্নত থাকত; তাহলে বরকত ও জব্বার এ দু’জনকে বাঁচানো যেত। ডাক্তারি পরীক্ষা বলেছে, এরা অতিরিক্ত রক্তক্ষণের জন্য মারা গেছে।
“তখন ব্লাড ব্যাংক বলে কিছু ছিল না। আমি লিখেছি, বলেছিও- যদি সুচিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতো, প্রধান যে চারজনের নাম বলা হয়, তার তিনজনই (সালামসহ) অন্তত বেঁচে যেত। এ অবস্থার জন্য আমরা নিজেরা দায়ী। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে তো বাঙালি, তারা তো করেনি।”
পুনরাবৃত্তিতে অনীহা
একুশের ঘটনা নিতে নতুন করে পুনরাবৃত্তি করতেও অনীহা আহমদ রফিকের। এক পর্যায়ে বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারির কথা তুলবেনই না আমার কাছে। সবই তো বইয়ে লেখা রয়েছে, আমি লিখেছি; বছরের পর বছর একই বিষয় বিভিন্ন সংগঠন রেকর্ড করেছে। গতানুগতিক পথে চলবেন কেন আপনারা?”
নবতিপর আহমদ রফিকের এখন চলাচলেও বেশ অসুবিধা। মেরুদণ্ডে চিড় নিয়ে অনেকটাই অচল, ঘরের বাইরে কোথাও তেমন যান না।
শরীরের অবস্থা ‘খুব খারাপ’ বলার পর স্মিত হেসে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “নিজের উপর বিরক্ত। এতদিন বেঁচে আছি কেন?”