কমলাপুরের ‘মেসি-নেইমার’রাও মাতলো

“টাকার জন্য জার্সি কিনতে পারি নাই। একটা ছোট পতাকা কিনছিলাম। ভাইয়েরা আজকে জার্সি দিছে।” বলল সামির।

শাহরিয়ার নোবেলনিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2022, 12:22 PM
Updated : 26 Nov 2022, 12:22 PM

হৃদয়, আকমান, আকাশ, সামির, তুফান কিংবা রাজা- ওদের বাড়িঘর কমলাপুর স্টেশনই। কেউ ট্রেনে ফেলে যাওয়া বোতল-প্লাস্টিক কুড়ায়, কেউ মালামাল টানে, আবার কেউ যখন যে কাজ পায়- তাই করে।

ক্ষুধা, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবন চালিয়ে নেওয়া এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও মাতল ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনায়। তাদের মাঝেও আছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ভাগ, ছিল প্রিয় দলের জার্সি পরার ইচ্ছা। তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এলো ঢাকা ইয়ুথ ক্লাব।

ক্লাবটির উদ্যোগে শনিবার কমলাপুর রেলস্টেশনের সুবিধাবঞ্চিত ৩০ শিশু পেয়েছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার জার্সি। এই দুই দলে ভাগ হয়ে খেলেছে প্রীতি ফুটবল ম্যাচও। খেলা শেষে ছিল খেলাধুলার সরঞ্জাম উপহার ও খাবারের আয়োজনও।

প্রিয়দলের জার্সি পেয়ে আনন্দের বৃষ্টি ঝরছিল ওই শিশুদের কণ্ঠে। মেসির নাম লেখা আর্জেন্টিনার জার্সি পেয়ে উচ্ছ্বসিত সামির বললো, “টাকার জন্য জার্সি কিনতে পারি নাই। একটা ছোট পতাকা কিনছিলাম। ভাইয়েরা আজকে জার্সি দিছে। আমার জার্সির পিছে মেসি লেখা। অনেক ভাল্লাগতাছে।“

ব্রাজিল সমর্থক তুফান বলছিল, “নেইমাররে ভাল্লাগে তাই ব্রাজিল করি। জার্সি কিনার শখ আছিল, টাকা আছিল না। জার্সিটা পাইয়া সেই লাগতাছে।“

সকাল সাড়ে এগারোটায় রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন প্রাঙ্গণে এই আয়োজন শুরু হয়। এমন আয়োজন আয়োজন কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন ঢাকা ইয়ুথ ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট আওলাদ হোসেন রবিন।

তার কথায়, “আমরা বাসায় থাকছি, খেলা দেখছি, আনন্দ করছি। কিন্তু এই শিশুরা যারা পথে পথে থাকে, তারা এই আনন্দে শামিল হতে পারছে না। তাদেরও জার্সি কেনার ইচ্ছা আছে, খেলার ইচ্ছা আছে, কিন্তু পারে না। আনন্দ একা করা যায় না, সবাইকে নিয়ে আনন্দ করতে হয়। এই ভাবনা থেকেই পথশিশুদের নিয়ে আমরা এই আয়োজনটি করেছি।“

সংক্ষেপে বক্তব্য শেষে শিশুদের মধ্যে জার্সি বিতরণ শুরু হয়। তখন শিশুরা উল্লাসে মেতে ওঠে, ছিন্নবসন খুলে বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে পরে প্রিয়দলের জার্সি।

জার্সি গায়ে জড়িয়ে একেকজনের মাঠে নামার জন্য যেন আর তর সইছিল না। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রেলস্টেশন প্রাঙ্গণে মাঠে নামে কমলাপুরের মেসি-নেইমাররা।

খেলার ব্যাকরণ ছাপিয়ে তাদের বাঁধনহারা আনন্দ ফুটবলের সৌন্দর্যকেই যেন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, যে খেলা পৃথিবীর সব মানুষকে এক করে ফেলে।

খেলায় দুই দলের মাঝে যেমন ছিল জেতার তাড়না, ঠিক তেমনি ছিল ভাতৃত্বের বন্ধনও। রেফারির সিদ্ধান্তে খুশি না হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ থেকে শুরু করে, বিপক্ষ দলের কেউ পড়ে গেলে উঠিয়ে দেওয়া সবই ছিল খেলায়।

খেলার মাঝামাঝি সময়ে গোল পেয়ে এগিয়ে যায় ব্রাজিল শিবির। হই হই রব উঠে যায় ব্রাজিলের দর্শকদের মধ্যে। তবে ব্রাজিলের এই আনন্দ শেষ পর্যন্ত আর স্থায়ী হয়নি। ম্যাচের শেষদিকে পেনাল্টি পেয়ে যায় আর্জেন্টিনা। সমতাসূচক ওই গোলে ড্র হয়ে যায় ম্যাচ। ফলে মন খারাপ করতে হয়নি কোনো দলকেই।

খেলার উত্তেজনা শেষে ওই শিশুদের মধ্যে ক্রীড়া সরঞ্জাম তুলে দেন আয়োজকরা। পরে প্রায় ৫০ জন শিশুকে নিয়ে প্রীতিভোজের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। 

ঢাকা ইয়ুথ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সোহাগ মহাজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত বিবেকের তাড়নায় আমাদের আজকের এই আয়োজন। আমরা বিশ্বকাপ নিয়ে আনন্দে মেতেছি, কিন্তু এই পথশিশুরা ইচ্ছা থাকলেও পারছে না।

“মানুষ হিসেবে সমাজের এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি যে দায়বোধ সেটি থেকেই ছোট পরিসরে হলেও আমরা তাদের মধ্যে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছি। আমরা যদি তাদের খেয়াল না রাখি, তবে তারা সমাজের মূলস্রোত থেকে আরও দূরে সরে যাবে।“

এ আয়োজনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ইয়ুথ ক্লাবের উপদেষ্টা মোস্তাফিজুর রহমান, সহ-সভাপতি আওলাদ হোসেন রবিন ও রফিকুল ইসলাম সেন্টু, সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন জুয়েল ও যুগ্ম সম্পাদক জনাব সাজ্জাদ হুসাইন।

১৬ বছর ধরে ঢাকা ইয়ুথ ক্লাব রাজধানীর বিভিন্ন থানায় শীতবস্ত্র বিতরণ, দুর্যোগে সাড়াদান, ঢাকার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-নদী রক্ষা, তরুণদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে নানা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।