“আমরা কোচিং নির্ভরতা কমানোর জন্য একটা শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করছি,” নানান অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষা সচিব আবু বকর ছিদ্দিক।
Published : 03 Oct 2022, 01:39 AM
ঢাকার শাহজাহানপুরের উত্তরা ব্যাংকের গলি সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে হয়ে উঠেছে স্কুলের বিকল্প; অনেকের কাছে শ্রেণিকক্ষের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
সেসব বাসাবাড়িতে নামে বেনামে গড়ে উঠেছে শতাধিক কোচিং সেন্টার। এমনকি ফার্মেসির সাইনবোর্ড টানিয়ে ভেতরে শিক্ষার্থী পড়াতেও দেখা গেছে।
ওই এলাকায় সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব সেন্টারে পড়ান ঢাকার কয়েকটি নামী স্কুলের শিক্ষকরা, শ্রেণিকক্ষে যাদের পাঠদানে নিশ্চিত হতে পারছেন না অভিভাবকরা। যে কারণে বাধ্য হয়েই তারা সন্তানদের নিয়ে আসছেন একই শিক্ষকের কোচিং সেন্টারে; মাসের ব্যয়ের হিসাবে যা তৈরি করছে বাড়তি চাপ।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল ও মুগদা শাখা, মতিঝিল সরকারি বালক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মত নামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরই এসব কোচিং সেন্টারে বেশি আসতে দেখা গেছে। পড়াচ্ছেনও এসব শিক্ষালয়ের শিক্ষকরা।
শুধু শাহজানপুরেই নয়, ঢাকার অন্যান্য স্থানেও নামী স্কুলগুলোর আশেপাশের এলাকায় একইভাবে গড়ে উঠেছে কোচিং সেন্টার যেখানে স্কুল ছুটির আগে ও পরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আনাগোনা চোখে পড়ে। ঢাকার বাইরের মহানগর ও শহরগুলোর চিত্রও কমবেশি একই রকম।
এসব কোচিং সেন্টারে অনেকটা ‘বাধ্য হয়েই’ পড়তে আসার অভিযোগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কথায়। ক্লাসের বদলে নিজের সেন্টারে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নিশ্চিত করতে ‘কোচিং প্রিয়’ শিক্ষকদের নানা কূট কৌশলের কথাও তুলে ধরেছেন তারা।
গত দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকার বিভিন্ন নামী স্কুল সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারের খোঁজ খবর নিয়ে এমনটাই জানা গেছে।
এ নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযোগের মধ্যেও কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানোর এমন প্রবণতা বন্ধে শিক্ষা সচিব আবু বকর ছিদ্দিক সচেতনতাকেই প্রধান ভরসা মানছেন।
“আমরা কোচিং নির্ভরতা কমানোর জন্য একটা শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করছি। কোচিং কেন করতে হয়? নতুন শিক্ষাক্রমে এই কোচিং নির্ভরতা কমে যাবে,” বলেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব কোচিং সেন্টার কয়েকজন শিক্ষক মিলে যেমন পরিচালনা করেন, তেমনি একাও অনেকে কোচিং করাচ্ছেন। আবার কোন কোন শিক্ষক আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে ব্যাচ করে ছাত্র পড়াচ্ছেন।
শাহজানপুরের বাটারফ্লাই কিন্ডারগার্ডেন নামের কোচিং সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, আইডিয়াল স্কুলের বিভিন্ন শাখার দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পড়তে এসেছে। চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী বলছিল, ক্লাসে সব পড়ানো হয় না, কোচিং করলে সিলেবাস শেষ হয়।
তাদেরই একজনের অভিভাবক জানান, বাচ্চাকে বাংলা, সমাজ ও ধর্ম পড়াতে এনেছেন। ক্লাসে এখন তেমন কিছুই পড়ানো হয় না, সেজন্য কোচিংয়ে পড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
অন্য শিক্ষকের কাছে পড়ানোর চেয়ে স্কুলের শিক্ষকের কাছে পড়ানোকে তিনি ‘ভালো মনে করেন’, কারণ এতে ‘রেজাল্ট ভালো হয়’।
তার ভাষ্য, “না পড়ালে বাচ্চারা শিট পায় না। তাদের প্যাটার্নে না লিখলে তারা কেটে দেন।”
অন্যান্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ায় সন্তানের মন খারাপ দেখে বাধ্য হয়ে স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়ানোর কথা জানান তিনি।
এসব কারণে অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ থাকলেও তাদের বড় অংশই এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নন।
মতিঝিল আইডিয়ালের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, “বাচ্চা রেজাল্ট খারাপ করলে বাধ্য হয়েই পড়াতে হয়। আমরা ক্লাস টিচারদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। কোথাও কিছু বলতে পারি না, বললেই রেজাল্ট খারাপ করিয়ে দেবে।
“অন্য শিক্ষকের কাছে খাতা গেলেও একই ঘটনা ঘটে। কারণ তাদের পড়ানোর প্যাটার্ন, শিট একই রকম।”
তার অভিযোগ, “ক্লাসে শিক্ষকরা জানতে চান, তার কোচিং সেন্টারের নাম জানে কি না। কোচিংয়ে না পড়লে দাঁড়ি, কমায় ভুল হলেও শূন্য দিয়ে দেয়। ফেইল করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর অভিভাবকরা বাধ্য হন কোচিংয়ে পাঠাতে।”
বাটারফ্লাই কিন্ডারগার্টেনে এখনই বার্ষিক পরীক্ষার নমুনা প্রশ্নপত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী বাচ্চাদের হাতে হাতে প্রশ্নোত্তরের শিটও দেখা যায়।
এখানে সমাজ, বাংলা ও ধর্ম বিষয়ে পড়ান মতিঝিল আইডিয়ালের শিক্ষক মাসুদা সুলতানা। তার দাবি, শিক্ষার্থীরা তার কাছে আমানত, যাদের কখনোই তিনি পড়তে চাপ দেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পড়লেই বেশি নম্বর দিব, না পড়লে কম দিব- এটি আমি কখনই করিনি।”
শিক্ষকরা যে ‘কোচিংয়ে আসতে চাপ দেন ও নম্বর কম দেন’ সেটি স্বীকার করে তিনি বলেন, “অনেকে আছেন, যাদের কারণে শিক্ষকদের দুর্নাম হয়। আমি তেমন না। অভিভাবকরা আমাকে পছন্দ করে পড়াতে চান বলেই পড়াই।”
এই কোচিং সেন্টারের ইংরেজি শিক্ষক আইডিয়ালের মুগদা শাখার মতিউর রহমানের দাবি, তিনি নিজের শাখার চেয়ে আইডিয়ালের অন্য শাখার শিক্ষার্থীদের বেশি পড়ান।
একইভাবে একই স্কুলের বনশ্রী শাখার শিক্ষকরাও বনশ্রী ও আফতাবনগর এলাকায় কোচিং করান। বনশ্রী আইডিয়ালের এক অভিভাবক বলেন, “চারজন শিক্ষকের কাছে পড়াতে মাসে ছয় হাজার টাকা চলে যাচ্ছে। এরপর স্কুলের বেতন, টিফিন, যাতায়াতে বাচ্চার জন্য ১২-১৩ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
“আমার ঢাকায় বাড়ি আছে দেখে এটা জুলুম হচ্ছে না। কিন্তু যাদের ভাড়া দিয়ে চলতে হয়, তাদের জন্য এটা অনেক কঠিন।”
শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো ও নম্বর কম দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বলেন, "আপনারা এসব কোথা থেকে শুনেন? কোথায় পেয়েছেন? আমরা তো শুনি না। সব স্কুলের টিচাররাই কোচিং করান।
"এই কোচিংয়ের বিষয়ে আমাদের কাছে সরকারের যে নির্দেশনা দেয়, আমরা সেটা টিচারদের জানিয়ে দেই।"
ঢাকার হলিক্রস স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর গত অগাস্টে আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষকদের কোচিং করানোর বিষয়টি সামনে আসে। রাজধানীকেন্দ্রীক স্কুলগুলোতে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকদের কাছে না পড়লে নম্বর কম দেওয়া, শ্রেণিকক্ষে ‘অপমান’ করা এমনকি অকৃতকার্য করিয়ে দেওয়ার মত গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বছরের পর বছর চলা এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের নম্বর কম দিতে না পারে সেজন্য খাতায় কোড সিস্টেম চালু করেছে। এরপরও নানাভাবে অনেক শিক্ষক ছাত্র ছাত্রীদের পড়তে বাধ্য করছেন।
বাংলা মাধ্যমের মত ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাও কোচিংয়ে পড়তে বাধ্য হন। ক্লাসে পড়া শেষ না হওয়ায় ভাল রেজাল্ট করতে নিজেদের শিক্ষকের কাছেই পড়েন অধিকাংশ শিক্ষার্থী।
কয়েকজন অভিভাবক জানান, ইংরেজি মাধ্যমে ক্লাস করার চেয়ে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে পড়তেই বেশি আগ্রহী। কারণ ক্লাসের পড়ায় তেমন সুবিধা করা যায় না। এছাড়া শিক্ষার্থীদের আরও ভালো বোঝা ও জানাশোনার জন্য বাসায় টিউশনির ব্যবস্থাও করছেন বলে তারা জানান।
যা বলছেন অভিভাবক-শিক্ষকরা
মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের রূপনগর শাখার আশেপাশের গলিতে সন্ধ্যার পরও শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেস পরে কোচিংয়ে যেতে দেখা যায়।
সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, স্যারদের কাছে না পড়লে ক্লাসে পড়া পারলেও হয়নি বলে দাঁড় করিয়ে রাখে। মারধর করে, নম্বর কমিয়ে দেয়।
“তাদের কাছে পড়লে পরীক্ষার সব উত্তর দিয়ে দেয়। আমরা এভাবে পড়তে চাই না। তারা বাবা-মাকে ফোন করে জ্বালাতন করে পড়ার জন্য।”
এ বিদ্যালয়ের মূল শাখার (বালিকা) নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, সন্তানের রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় গত অগাস্টে কয়েকজন শিক্ষক তাকে ডেকে নিয়ে কোচিং করানোর জন্য ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দেন।
“কয়েকদিন কোচিংয়ে দিয়েছিলামও। কিন্তু এত বাচ্চা একসাথে পড়ে যে, সে কিছুই বুঝতে পারে না। না বুঝলেও সমস্যা নাই, পাস মার্ক দিয়ে দিবে। কিন্তু এসএসসির খাতা তো ওরা দেখবে না, তাই এখন বাইরের শিক্ষকের কাছে পড়াচ্ছি।”
বিভিন্ন সময়ে অভিভাবকরা অভিযোগ দেওয়ার পর এই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ স্কুলের গণিত, ইংরেজি ও অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ‘নম্বরের ফাঁদে ফেলে’ শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেক অভিভাবকের। অকৃতকার্য হওয়ার ভয়ে অনেকে কোচিং করছে বলেও জানান তারা।
যেসব শিক্ষকের নামে অভিযোগ রয়েছে তাদের একজন ধর্ম নারায়ণ। গণিতের এই শিক্ষক এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, “কোচিংয়ে পড়তে কোনো শিক্ষার্থীকে চাপ দেওয়া হয় না।“
শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ালে কোচিংয়ের প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেক শিক্ষার্থী জোর করে পড়তে চায়। আবার এমন অনেক শিক্ষক আছেন, আমি তেমন না।”
অভিযোগের মুখে থাকা অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আলী পাপ্পু বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের শতভাগ পাস করাতে চাই। পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার বিষয় আমাদের স্কুলে থাকার কথা না। যারা অনেকে বেশি আগ্রহ দেখায়, তাদেরই শুধু পড়াই। বেশি আগ্রহ দেখালে তো না পড়িয়ে পারি না।”
এই দুই শিক্ষকই জানান, প্রতিষ্ঠান নির্দেশ দিলে তারা নিজেদের শিক্ষার্থী পড়ানো বন্ধ করে দিবেন।
এ বিষয়ে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখার ইংরেজি ভার্সনের একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, কোচিং না করলে শিক্ষকরা আর্থিক সামর্থ্য নিয়েও ক্লাসে প্রশ্ন তোলেন। শিক্ষার্থীদের এমনভাবে ছোট করে দেওয়া হয়, তারা পড়াতে বাধ্য হন।
অভিযোগে নাম আসা এ স্কুলের বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের শিক্ষক প্রকাশ চন্দ্র রায় বলেন, “আগে পড়াতাম, এখন আর ওইভাবে পড়াচ্ছি না। সরকারের সার্কুলার অনুযায়ী নিজেদের বাচ্চাদের আর পড়াচ্ছি না। আমাদের আইডিয়াল এ ব্যাপারে খুবই স্ট্রিক। এখন আমরা ক্লাসরুমেই শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সাপোর্ট দিচ্ছি, কাউন্সিলিং করছি।”
রাজধানীর আরেক নামকরা বিদ্যালয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখার পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা জানান, আগে শিক্ষকদের কাছে না পড়লে খারাপ ব্যবহার করত, নম্বর কম দিত। এখন পরীক্ষার খাতায় কোড সিস্টেম রাখায় সেসব সমস্যা হচ্ছে না।
“তবে স্কুলের টিচারের কাছে পড়লে পরীক্ষার আগে কিছু সাজেশন পাওয়া যায়, তা থেকে কমনও আসে।”
এ শাখার প্রভাতির জুনিয়র শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, ড্রইং শিক্ষকের কাছে না পড়ে তার মেয়ে কম নম্বর পেয়েছে। বাচ্চা মন খারাপ করে, সেজন্য বাধ্য হয়েই এখন পড়াচ্ছেন।
এসব বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহারকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
ব্যতিক্রমও আছে
ঢাকার শিক্ষকদের বড় অংশ টিউশনি করালেও ব্যতিক্রমও আছে। ৩২ বছর ধরে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াচ্ছেন আবু সালেহ খোরশেদ। ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার এই শিক্ষক কখনই প্রাইভেট পড়ান না বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা।
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার কাছে মনে হয়, একাডেমিক পড়াগুলো ক্লাসেই শেষ করে দেওয়া উচিত। সেটা কোচিং বা বাসার জন্য রাখা উচিত না। সে কারণেই আমি বাইরে পড়াই না। কোনো শিক্ষার্থীর সমস্যা হলে আমি তা সমাধান করে দেই। কিন্তু প্রাইভেট পড়াই না।”
তার মত শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয় বলে জানান তিনি।
সরকারের নির্দেশনা কী বলছে
বিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব বিষয়ে অবহিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে জারি করা নীতিমালাতেও তা তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন, যা পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছে। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী না হয়ে কোচিংয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন। এতে দরিদ্র শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এর প্রেক্ষিতে নীতিমালায় নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে নিষেধ করা হয়। এছাড়া শিক্ষকরা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে যুক্ত হওয়া বা নিজে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলতে পারবেন না বলেও সবশেষ নির্দেশনায় বলা হয়।
সরকারের সবশেষ নির্দেশনা আসে ২০১২ সালের নীতিমালায়, যা ২০১৯ সালে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
এতে কোচিং বাণিজ্যে শিক্ষকরা জড়ালে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতা স্থগিত, বরখাস্ত করাসহ নানা শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়।
তবে এসব নির্দেশনা থাকলেও নীতিমালা বাস্তবায়নে কোনো তোড়জোড় দেখা যায়নি, ফলে কোচিং বাণিজ্যের পরিসর আরও বেড়েছে।
কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এখন প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনকে সামনে আনছে, যা বাস্তবায়ন হলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে বলে আশা করছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। এ আইনে নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের টাকার বিনিময়ে পড়ানোকে শাস্তিযোগ্য বলে গণ্য করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
হলিক্রস স্কুলের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনার পর শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কোচিং না করলে শিক্ষকরা ফেইল করিয়ে দেওয়ার মত অন্যায় কাজও করছেন।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন বাস্তবায়িত হলে নিজের শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সুযোগ থাকবে না, কোচিংয়ে বাধ্য করাও বন্ধ হবে বলে আশা তার।
অগাস্টে ওই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় তদন্তে নেমেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে কঠিন প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয় তৈরি করে শিক্ষকদের কোচিং করতে বাধ্য করার তথ্য এসেছে।
হলিক্রসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষকরা কোচিংয়ে পড়তে চাপ না দিলেও প্রশ্ন কঠিন হওয়ায় পাস করা কঠিন হয়ে যায়।
দিবা শাখার অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, “হলিক্রসে রেজাল্ট খারাপ হলেও শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষায় ভালো করে। সেভাবেই পড়ানো হয়। শিক্ষকের কাছে আমি কোচিংয়ে পড়ি কারণ তিনি ভালো পড়ান। আর পড়লে পরীক্ষার প্রশ্ন বোঝা সহজ হয়।”
দ্বিতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, “আমার বাচ্চাকে বাসায়ই পড়াই। কোন শিক্ষক কোচিংয়ে দিতে বলেননি কখনও।”
যা বলছে মন্ত্রণালয়
২০১৭ সালে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ সুপারিশের প্রেক্ষিতে পরের বছর ২৫ জন শিক্ষককে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। এরপর আর কোচিং বাণিজ্য ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো তদারকি কার্যক্রমের খবর মেলেনি।
‘অনেক শিক্ষক ক্লাসে না পড়িয়ে বাসায় পড়তে বাধ্য করেন, নম্বরও কম দেন’- এমন অভিযোগ থাকার কথা বলছেন শিক্ষা সচিব আবু বকর ছিদ্দিকও।
এসব বিষয়ে নজরদারি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যারা টাকার বিনিময়ে পড়ায়, সেটা দুর্ভাগ্য। বাসায় পড়ালে কীভাবে ব্যবস্থা নেব? তারা বলবে, তাদের ছাত্ররা পড়া বুঝে না তাই বুঝতে আসছে। এটা একটা সমস্যা আছে।
আইনের প্রয়োগ করা কঠিন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সচেতন না হলে আসলে কিছুই সম্ভব না। টিচারদের বাসায় তো হামলা করা যায় না।”
অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে শিক্ষা সচিব বলেন, “এ ধরনের কোন পরিকল্পনা আছে বলে আমার জানা নাই। আমরা জানি এ ধরনের বিষয়গুলো ঘটছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো ঠিক হবে বলে আমার মনে হয় না। সচেতনতা বৃদ্ধি করে আগাতে হবে।“
সমাধান কোথায়?
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জানান, শিক্ষকের কাছে কোচিং না করায় নম্বর বৈষম্যের ঘটনা তার নিকটাত্নীয়ের সঙ্গেও ঘটেছে।
স্কুলে ভালো না পড়িয়ে কোচিং করানোর মানসিকতার জন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম থাকাকেই দায় দিচ্ছেন তিনি।
“জেলা প্রশাসকের পিওনের চেয়েও শিক্ষকের বেতন কম। বাধ্য হয়ে তারা কোচিং করাচ্ছেন। কম নম্বর দেওয়াসহ নানা টেকনিক করছে, যাতে বাচ্চারা আসে। দীর্ঘ চর্চার মধ্য দিয়ে টিউশন প্রথায় রূপ নিয়েছে। যেমন নোট-গাই দিয়ে বই থেকে নজর সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।“
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, “প্রথমেই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে। এরপর কোচিং বাণিজ্য বন্ধে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অধীনে মনিটরিং সেল করে দিতে হবে।
“শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। স্থানীয় শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যক্তিদের দিয়ে শক্তিশালী কমিটি করে দিতে হবে। এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিংয়ের জন্য চাপ বা পক্ষপাতের অভিযোগ আসলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।”
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটির সদস্য মনজুরুল ইসলাম বলেন, “নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের চাপ দেওয়া একেবারে কমে যাবে। সেজন্য কারিকুলাম যেন স্ট্রংভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষকরা চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছে কি না তা দেখতে অভিযান চালাতে হবে। গণমাধ্যমের নজরদারি থাকতে হবে।”
নম্বর বৈষম্যের সুযোগ বন্ধে শ্রেণি শিক্ষকের খাতা দেখার সুযোগ তুলে দেওয়ার পাশাপাশি দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় পরীক্ষক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীদের নাম ও রোল নম্বরের পরিবর্তে কোড নম্বর ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুদিন বন্ধের সুযোগে রমরমা কোচিং বাণিজ্য
কোচিং না করলে ফেইল করানোর ‘অপরাধজনক কাজ’ হচ্ছে: শিক্ষামন্ত্রী
প্রত্যাশার চাপ নিতে পারেনি মেয়েটি?
‘কোচিং সেন্টারের’ প্রশ্নপত্রে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা
কোচিং বাণিজ্য: ঢাকার ২৫ স্কুল শিক্ষক বদলি
কোচিং বাণিজ্য: ঢাকার আট স্কুলের ৯৭ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ