ভালো ফলের জন্য যে চাপ ছিল তা ‘স্বীকার’ করেছেন মেয়েটির শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
Published : 24 Aug 2022, 11:31 PM
উচ্চতর গণিতে পাশ না করায় সহপাঠীদের সঙ্গে শলা-পরামর্শে প্রশ্ন উঠেছিল কীভাবে বাসা ম্যানেজ করবে, জবাবে মেয়েটি বলেছিল, ‘দেখিস কীভাবে করি’।
এর খানিক পরই ঢাকার তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকার বাসায় ফিরে ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন হলিক্রস স্কুলের নবম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থী। তখনও তার গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম।
মঙ্গলবার বিকালে লাফিয়ে পড়ার সময় নিচ থেকে অনেকে দেখে নিষেধ করলেও ওই কিশোরী তা শোনেননি বলে জানান স্থানীয়রা। এই দৃশ্য দেখে অনেকে কেঁদেও ফেলেন।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই স্কুলের এক শিক্ষককে ইঙ্গিত করে বলছেন, ‘তার কাছে’ প্রাইভেট ‘না পড়লে’ তিনি ফেইল করিয়ে দেন। উঠে এসেছে অভিভাবকদের পক্ষ থেকেও ফলাফল নিয়ে চাপ থাকার কথা।
নবম শ্রেণির ‘সি’ সেকশনে ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে নিজের ভাগ্নি পড়তেন জানিয়ে হাসিবুজ্জামান নামে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় নবম শ্রেণির অনেকগুলো মেয়ে উচ্চতর গণিতে ফেইল করে।
“তার ভাগ্নি এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে শুনে তারও ধারণা হয় যে, প্রাইভেট না পড়ার ফলে ফেইল করিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
হাসিবুজ্জামান বলেন, “তার ভাগ্নি বলেছে, মেয়েটি প্রথম সাময়িকীতে হায়ার ম্যাথে ফেইল করেছিল। দ্বিতীয় সাময়িকীতেও সে ফেইল করেছে। তার বাবা-মাকে স্কুল থেকে ডাকার কথা ছিল বৃহস্পতিবার।
“শিক্ষকরা ফেইল করা ছাত্রীদের বাবা-মাকে ডেকে অপমান করছেন, এরকম কথাও ছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে তারা অনেকেই আতঙ্কিত হয়। ক্লাসে এ নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে অনেক শলা-পরামর্শও করে।
“এরকম আলোচনার সময় মঙ্গলবার মেয়েটিকে তার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, এখন কিভাবে বাসা ম্যানেজ করবি? মেয়েটি তখন বলেছিল, দেখিস কীভাবে করি। এর কিছুক্ষণ পরেই সোশাল ওয়েবে মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ আসে।”
মেয়ের মৃত্যুর জন্য ওই শিক্ষককে দায়ী করছেন ওই ছাত্রীর মাও। তবে এ বিষয়ে কোনো মামলা বা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তিনি।
তারা শুনেছেন, ফলাফল খারাপ হওয়ায় উচ্চতর গণিতের শিক্ষক অনেক রাগারাগি করেছেন। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের ডাকার কথাও বলা হয়।
“অনেক অভিভাবকের সঙ্গে নাকি কর্কশ ভাষায় কথা বলা হয়েছে। এসব নিয়েই হয়তো মেয়েটা চাপে পড়েছিল।”
তবে এসব অভিযোগ ‘মোটেও সত্য নয়’ দাবি করে শ্রেণি শিক্ষক রোকেয়া বেগম বলেন, “অনেক গণমাধ্যমে অভিভাবকদের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে ও ক্লাসে প্রথম হতো। কিন্তু বিষয়টি এরকম নয়, ও মধ্যম মানের ফল করে আসছিল।
“তবে এবার প্রথম সাময়িকী পরীক্ষায় উচ্চতর গণিত ও জীববিজ্ঞানে ফেইল করে। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় আবারও উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞানের সঙ্গে সাধারণ গণিতেও ফেইল করে।”
একজন শিক্ষকের প্রতি অভিভাবকদের যে অভিযোগ সে প্রসঙ্গে শ্রেণি শিক্ষক রোকেয়া বেগম বলছেন, “এরকম কিছু হলে তো মেয়েটি অন্য বিষয়গুলোতে ফেইল করত না। সে আরও দুটো বিষয়েও ফেইল করেছে।”
অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের রূঢ় আচরণের অভিযোগও নাকচ করে দেন এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “আমরা তাদের ডেকে বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলি। নবম শ্রেণির এতগুলো ছাত্রী কেন খারাপ ফলাফল করল এ নিয়ে তারা সতর্ক ছিলেন। তবে কারও সঙ্গে রূঢ় আচরণের প্রশ্নই ওঠে না।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এ প্রতিবদকের সঙ্গে কথা হয় স্কুলের আরও কয়েকজন নারী শিক্ষকের।
তারা বলছেন, ছাত্রীদের কাছ থেকে তারা শুনেছেন মেয়েটি যেন ভালো ফলাফল করে সেজন্য তার পরিবার অব্যাহতভাবে চেষ্টা করছিল। তাকে বকা-ঝকা করা হতো বলেও তারা শুনেছেন।
ছাত্রীদের একজন বলেন, মেয়েটির বাবা অনেক কঠোর অভিভাবক। ভালো ফলাফলের জন্য চাপ দিতেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়েটির মা বলেন, “প্রথম সাময়িকী পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলের পর ওর বাবা শুধু বলেছিলেন, এবার ফেইল করলে বাড়িতে কোনো ইন্টারনেট লাইন রাখা হবে না।”
তিনি জানান, গৃহকর্তা ব্যবসা করেন। ছোট ছেলে পড়ে মাদ্রাসায়। এক ছেলে মেয়েকে নিয়ে তারা ছিলেন সুখী পরিবার।
মেয়ের স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করেই মাস ছয়েক আগে তেজগাঁওয়ের স্টেশন রোডের বাসায় উঠেছিল পরিবারটি। ১০ তলা ভবনের ১০ তলাতেই থাকে পরিবারটি। বাসার এক কিলোমিটারের মধ্যেই হলিক্রস স্কুল।
এমন মৃত্যুর তদন্তে বুধবার হলিক্রস স্কুলে এসেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা মেয়েটির পরীক্ষার খাতাগুলো দেখেছেন।
মাউশির একজন কর্মকর্তা জানান, পরীক্ষার খাতাগুলো দেখে প্রাথমিকভাবে তাদের মনে হয়েছে সেগুলো সঠিকভাবেই মূল্যায়িত হয়েছে। তবুও তারা সেগুলো নিয়ে যাচ্ছেন।
ওই শিক্ষার্থীর ‘আত্মহত্যার’ পেছনে ‘ফেইল করানোর’ মতো কোনো কারণ রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে বুধবার দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)।
বুধবার অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ তথ্য জানান।
ডিআইএ‘র উপপরিচালক রেহানা খাতুনকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটির আরেক সদস্য হলেন শিক্ষা পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন।
অধ্যাপক অলিউল্লাহ বলেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি যে, সেই শিক্ষার্থী উচ্চতর গণিতের প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ফেইল করেছিল। সেই অপমানেই সে আত্মহত্যা করেছে।
“আর সেই শিক্ষার্থী ওই বিষয়ের শিক্ষকের কাছে না পড়ায় তাকে ফেইল করানো হয়েছে। এটি তদন্তেই আজকে তদন্ত কমিটির দুইজন গিয়েছিল। তারা পরীক্ষার খাতাগুলো নিয়ে এসেছে।
“তদন্ত কমিটি ও বোর্ডের কয়েকজন খাতাগুলো পুনর্নিরীক্ষা করে দেখবে যে, তাকে ফেইল করানো হয়েছে কি না। মূলত আমরা দেখতে চাই, তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেইল করানো হয়েছে কি না।”
তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলম জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার বিকাল ৪টার পর মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরে বাসার দরজায় ব্যাগ রেখে ওপরে উঠে যায়।
এই ঘটনার একটি ভিডিও পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ভিডিওতে দেখা যায়, মেয়েটি স্কুলের ইউনিফরম পড়া অবস্থাতেই ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ছে।
এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই মেয়েটির লাশ নিয়ে দাফন করেছে পরিবার। তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান জানান, পরিবারের কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।