“বায়ুমণ্ডলের তিনটি স্তরে এখন ধোঁয়াশা বিরাজ করছে, যা মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর,” বলছেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার।
Published : 16 Jan 2024, 08:02 AM
শীতের তীব্রতা বাড়ার পাশাপাশি সপ্তাহজুড়ে কমে গেছে দিনের দৃশ্যমানতা। সোমবার কিছু সময় সূর্যের দেখা মিললেও এর আগের পাঁচ দিন দেশজুড়ে তেমনটাও দেখা যায়নি।
প্রকৃতিতে যে সাদা আস্তরণ সূর্যের আলো ঠেকিয়ে দিচ্ছে, তাকে কেবল শীতের স্বাভাবিক কুয়াশা হিসেবে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্য, কুয়াশার সঙ্গে দূষণ মিশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে- যা সূর্যের আলোকে ঢেকে দিচ্ছে। আর কুয়াশার সঙ্গে দূষণের যোগ কেবল দিনের দৃশ্যমানতা কমিয়ে দিচ্ছে না, বাড়িয়ে দিচ্ছে শীতের অনুভূতি।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিকের পর্যবেক্ষণ, ১১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে যে ঘন কুয়াশার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, একই অবস্থা বিরাজ করছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে।
ভারতের দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে ঘন কুয়াশা বিরাজ করছে।
এর কারণ হিসেবে আবুল কালাম মল্লিক বলছেন, দিনের বেলা সূর্যের আলো ভূ-পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করতে পারছে না।
“ভূ-পৃষ্ঠের ঠান্ডা বাতাসের উপর দিয়ে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হলে এ ধরনের ঘন কুয়াশা তৈরি হয়। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ ঠান্ডা এবং তার উপরে বাতাসও কিছুটা ঠান্ডা। এর উপর দিয়ে জলীয় বাষ্পসহ বাতাস প্রবাহিত হলে কুয়াশা হয়। রাতে ভূ-পৃষ্ঠ ঠান্ডা হয়ে যায়। তার উপরে দিনের আলো পড়ার পর কুয়াশা আরও বেড়ে যায়।"
এই পরিস্থিতিকে 'স্ট্র্যাটাস ক্লাউড' বলা হয় বলে জানালেন এই আবহাওয়াবিদ।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, "দিল্লি থেকে উত্তর ও মধ্য প্রদেশ হয়ে বাতাস বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তরপূর্ব দিক হয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
"এই বাতাস দূষিত পদার্থ নিয়ে এলে এবং দেশের অভ্যন্তরের দূষণের কারণে এই কুয়াশা তৈরি বৃদ্ধি পায়।"
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলছেন, শীতের স্বাভাবিক কুয়াশা থাকলে সেটি সূর্যের আলোতে সরে যেত এবং সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে আসত।
"কিন্তু এই কুয়াশাটা ধোঁয়া ও ধুলার সাথে মিশে গেছে। আমরা এটার নাম দিয়েছি ধোঁয়াশা। অর্থাৎ কুয়াশার সাথে দূষণ মিলিত হয়ে এই আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে।"
এর সঙ্গে শীতের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে এই অধ্যাপক বলেন, "নরমালি কুয়াশার ওজনের চেয়ে এই ধোঁয়াশা ভারি হয়ে যাচ্ছে। ভারি হয়ে এটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তিন-চার কিলোমিটারের একটি আস্তরণ তৈরি করে। এবং এটি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে।
"ফলে এটি ভেদ করে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারছে না। যতদিন যাচ্ছে, ততো আবহাওয়াটা দিনের বেলায় সন্ধ্যার মত দেখাচ্ছে। মূলত এটি একটি দূষণের আস্তরণ।"
প্রাকৃতিকভাবে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় জানিয়ে দূষণ কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার।
তিনি বলেন, "আমরা দূষণটা কমিয়ে আনতে পারি, যেন নতুন করে দূষণ এখানে যোগ না হয়। বৃষ্টি ছাড়া এই দূষণ কমানো সম্ভব না।"
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানিয়েছেন, বৃহস্পতি বা শুক্রবার নাগাদ হালকা বৃষ্টি হবে। এরপর ২০ জানুয়ারি থেকে রাতের তাপমাত্রা আবার বাড়তে থাকবে।
"শীতে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে এই ধরনের বৃষ্টিপাত হয়।"
অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, "বৃষ্টির ফলে যখন এই লেয়ারটা (ধোঁয়াশা) সরে যাবে, তখন সূর্যের আলো সরাসরি আসবে এবং ভূ-পৃষ্ঠের সাথে বায়ুমণ্ডলের একটা যোগাযোগ স্থাপিত হবে।"
বায়ুমণ্ডলের তিনটি স্তরে এখন ধোঁয়াশা বিরাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলছেন, এটি মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর।
এমন আবহাওয়ায় বয়স্ক ও শিশুদের বাসার বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ অধ্যাপক কামরুজ্জামানের।
“শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী নারী, শ্বাসকষ্টের রোগীদের বাইরে গেলে মাস্ক পড়তে হবে, সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।”
শীত আর ঘন কুয়াশায় ভোগান্তিতে মানুষ
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। কোথাও কোথাও এটি দুপুর পর্যন্ত থাকতে পারে।
কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িকভাবে বিঘ্ন ঘটতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
কাজের জন্য যাদের বাইরে বের হতে হচ্ছে, তারা শীত আর ঘন কুয়াশায় ভোগান্তিতে পড়ার কথা জানাচ্ছেন। দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় সমস্যায় পড়ার কথা বলছেন চালকরা।
গাবতলী থেকে বাড্ডাগামী রবরব পরিবহনের চালক মো. রফিক বলেন, শীত আর কুয়াশায় এখন যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে কম।
“সকালে কিচ্ছু দেখা যায় না। গাড়ি চালাই রিস্ক নিয়া, অনুমানে। আর শীতে তো মানুষ কাজ ছাড়া বাইর হইতে চায় না, যাত্রীও অনেক কমে গেছে।”
রিকশা চালক ইদ্রিস হোসেন বলেন, “কুয়াশার সাথে ঠান্ডা হাওয়ায় অনেক কষ্ট হইতেছে। কিছু করারও নাই। না বাইর হইলে তো খাওন বন্ধ হয়া যাইব। গরিবের আবার কীসের শীত!”
সকালের স্কুল শিক্ষার্থী ও অফিসগামীরাও দু্র্ভোগে পড়ছেন শীতে।
স্কুলের জন্য সকাল সাড়ে ৬টায় বের হতে হয় মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফিয়া ইসলামকে।
ভোগান্তির কথা জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, “সাড়ে ৭টা থেকে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু এক ঘণ্টা আগে বের হতে হয়। একেবারে অন্ধকার থাকে তখন, শীতও থাকে অনেক। রাস্তাঘাটে রিকশাও থাকে না।
“গতবারও এইসময় এমনটা ছিল না। এবার অনেক কুয়াশা। কিছুই দেখা যায় না। স্কুলের জন্য বের হতে অনেক কষ্ট হয়।”
এনজিওকর্মী মৌসুমী দাস বলেন, “অফিসের জন্য সকাল সোয়া ৭টা থেকে সাড়ে ৭টায় বের হই। এতো সকালে হয় সিএনজি বা বাইকে করে যেতে হয়। গাড়ি পাওয়া যায় না।
“এভাবে বাতাসে ঠান্ডা লেগে গেছে। আর ঘন কুয়াশায় তো ভয়ই লাগে এই বুঝি একসিডেন্ট হলো। কারণ কিছুই দেখা যায় না।”